Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

উত্তরাঞ্চলে চার ও পূর্বাঞ্চলে পাঁচ দফা বন্যা

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে

অভিযোজন তহবিল থেকে অর্থ আদায়ে সোচ্চার হতে হবে -অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম

Icon

মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে

ফাইল ছবি

চলতি মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলে চতুর্থ আর পূর্বাঞ্চলে পঞ্চম দফা বন্যা চলছে। উভয় অঞ্চলে সর্বশেষ বন্যাটি শুরু হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর। এটি আরও কয়েক দিন চলতে পারে। জুনের প্রথমদিকে উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে প্রথম বন্যা দেখা দেয়। সেই থেকে তিন মাস ধরে মানুষ বন্যার সঙ্গে বসবাস করছে। এর মধ্যে ২৭ জুন থেকে এক নাগাড়ে দেড় মাস বন্যাকবলিত ছিল দেশের উত্তর, পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চল।

জলবায়ু ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে। এর প্রভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার হবে। চলতি বছর দফায় দফায় বন্যা, মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত, অতিবৃষ্টি, নজিরবিহীন জোয়ারে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা এবং গত কয়েক বছরের বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ পরিস্থিতি তাদের কথার সত্যতাই প্রমাণ করে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে যায়। এতে নানা ধরনের দুর্যোগ বেড়ে যায়। এবারের কয়েক দফা বন্যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যায়। এর কারণ হচ্ছে- আবহাওয়ার দুটি সিস্টেম সক্রিয় হলে পৃথিবীতে ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে যায়। এর একটি হচ্ছে ‘এল-নিনো বা লা-নিনো’, আরেকটি হচ্ছে ‘ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশন’ (এমজেও)। এবার এর কোনোটিই সক্রিয় নয়। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন, দীর্ঘমেয়াদি, রেকর্ড ভঙ্গকারী আর ভয়াবহ বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আছে। এবারের বন্যার প্রকৃতি আর গত কয়েক বছরের বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগের রেকর্ডও সেটাই প্রমাণ করছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, কয়েক দফা বন্যায় এবার দেশের ৩৫টি জেলা কবলিত হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় ৮ জেলা জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানিতে ডুবে বন্যার মুখোমুখি হয়। জুনের মাঝামাঝি প্রথমে তিস্তায় বন্যা হয়। বড় আকারের বন্যা শুরু হয় ২৭ জুন। সবমিলে এবার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, আপার মেঘনা, পদ্মা অববাহিকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি অববাহিকায় এবার বন্যা হয়েছে। এগুলোর প্রথম তিনটিতে বন্যা মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি রূপ লাভ করছে। শেষের বা চলতি বন্যা স্বল্পমেয়াদি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, এবার এখন পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রে চার দফা আর মেঘনা অববাহিকায় পাঁচ দফা বন্যা হয়েছে। তিস্তায় ছোটখাটো আরও দু-একটি বন্যা হয়েছে। এবারের বন্যা তুলনামূলক দীর্ঘ এবং ভয়াবহ। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, গাইবান্ধায় ফুলছড়ি পয়েন্টে যমুনা ও পদ্মায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রবাহিত হয়।

এছাড়া তিস্তায়ও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পানি প্রবাহিত হয়।

সম্প্রতি বুয়েটের ছয় গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের বন্যার ওপর একটি গবেষণা করেছেন। এতে নেতৃত্ব দেন বুয়েটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এ কারণে বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় যদি প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করা যায় এবং এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে বন্যা কী পরিমাণ বাড়বে, সেটা নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন।

তিনি আরও জানান, গঙ্গা অববাহিকায় বন্যা ২৭ শতাংশ বাড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় তা বেড়ে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং মেঘনা অববাহিকায় ৩৮ শতাংশ বেশি হতে পারে। এই বেশি মানে-এবার যেমন ৪ থেকে ৭ বার হয়েছে ৩ মাসে, তখন হয়তো বন্যা লেগেই থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বন্যার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। এবার মৌসুমের আগাম আগমন ঘটে। এবারের মৌসুম অনেক বেশি সক্রিয়। এ কারণে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। সাধারণ আরব সাগরের দিক থেকে আসা পশ্চিমা বায়ু এবং বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে ওঠা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ুর সংমিশ্রণে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনা ঘটে। আম্পানের পরপরই এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরব সাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় নিসর্গ। এ দুই ঘূর্ণিঝড়ের পর যে বৃষ্টিপাত প্রবণতা শুরু হয়, সেটি এখনও চলছে।

২০১৯ সালে এক বছরেই বুলবুল এবং ফণী নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ছিল তীব্র দাবদাহ। রেকর্ড শৈত্যপ্রবাহের ঘটনাও গতবছর ঘটেছে। ২০১৮ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় তিতলি। ওই বছর আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় পূর্বাঞ্চল। ছিল বজ পাতের প্রকোপ এবং কালবৈশাখীর ছোবল। এছাড়া অস্বাভাবিক তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ তো ছিলই। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। সিলেট অঞ্চলে দুটি বন্যা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার কারণে উত্তরাঞ্চলে একই বছর বন্যা হয়। ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত হানে। এর আগে ‘মহাসেন’, ‘আইলা’, ‘সিডর’ হয়ে গেল। ২০০৭ সালের পর মাত্র ১০ বছরে ৫-৭টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। অথচ এর আগে ১৯৯৮ সালে এবং তার আগে ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় হয়। অপরদিকে পাহাড় ধস ঘটানোর মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বজ পাত বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ পাতের দেশ বাংলাদেশ। টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বড়টি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের বড় কর্তব্য হচ্ছে দুর্যোগের প্রতি বিশ্বের নজর আকৃষ্ট করার পদক্ষেপ নেয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় গঠিত জাতিসংঘের অভিযোজন তহবিল থেকে অর্থ আদায়ে সোচ্চার হওয়া।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম