বিদেশিরা পাচার করছেন ২৬৪০০ কোটি টাকা
দেশে আড়াই লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন * ২১টি খাতে ৪৪টি দেশের নাগরিক কর্মরত * সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ভারতের, সর্বোচ্চ খাত গার্মেন্ট * অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক

যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমানে দেশের ২১ খাতে ৪৪ দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এর মধ্যে কর দিচ্ছেন ৯ হাজার ৫০০ জন। বাকি ২ লাখ ৪১ হাজার অবৈধ। এরা বেতনের নামে দেশ থেকে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করছেন। যা পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের প্রায় সমান। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতের। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতিবছর ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। এটি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মনজুর-ই-খোদা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সব খাতে বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, বৈধভাবে যাদের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে আরেকটু যাচাই-বাছাই করতে হবে। তবে প্রশ্ন হল অবৈধদের নিয়ে। তিনি বলেন, এর আগেও অবৈধ বিদেশিদের নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছিল। বিষয়টি উদ্বেগের। কারণ অবৈধভাবে কাজ করবে, এটি কোনো দেশই এখন আর মেনে নেয় না। তার মতে, প্রথমত এতে দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ অনুমতি ছাড়া কাজ করার মানে হল, তারা যে পরিমাণ অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে, তার পুরোটাই অবৈধ। দ্বিতীয়ত, বিষয়টি হল দেশের নিরাপত্তা। মির্জ্জা আজিজ বলেন, এসব অবৈধ বিদেশি জঙ্গি হামলাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিদেশে পাচার করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে মোট ২১ খাতে ৪৪ দেশের শ্রমিক বাংলাদেশে কাজ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ভারতের। সরকারি হিসাবে দেশটির ৩০ হাজারের বেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। এর পর চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে এবং নাইজেরিয়া উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার। এদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। আর বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশে নিয়ে যায় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছে ৩৯১ কোটি এবং অবৈধভাবে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর ফলে বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৫০০। আলোচ্য সময়ে তাদের মোট আয় ছিল ৬০৩ কোটি টাকা। আর এখান থেকে সরকারকে কর দিয়েছে ১৮১ কোটি টাকা। তবে টিআইবি বলছে, এটি সঠিক তথ্য নয়। এখানেও আয়কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। কারণ এই তথ্য অনুসারে প্রতিজন বিদেশি কর্মীর মাসিক আয় ৫৩ হাজার টাকা। যা একেবারে অসম্ভব।
কারণ এই পরিমাণ বেতনের জন্য কেউ বাংলাদেশে আসে না। যেসব খাতে বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন এগুলো হল- তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, বায়িং হাউস, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মোবাইল ফোন কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা, কার্গো সেবা, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস, আন্তর্জাতিক এনজিও, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি, অডিট, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, প্রকৌশল, ফ্যাশন ডিজাইন, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বেতনের তথ্য গোপন : বিদেশিদের বেতন দেয়ার ক্ষেত্রেও তথ্য গোপন করছে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি। টিআইবি বলছে, প্রাথমিকভাবে ১০টি ক্যাটাগরিতে চাকরি করছেন বিদেশিরা। এর মধ্যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বেতন দেখানো হচ্ছে ৩ থেকে ৩.৬ হাজার ডলার। কিন্তু এদের প্রকৃত বেতন ১০-১২ হাজার ডলার। এ ছাড়া প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা পদে ৮-১০ হাজার ডলারের স্থলে ২.৫-৩ হাজার ডলার দেখানো হয়। কমপ্লায়েন্স বা সোশ্যাল অডিটর পদে ৯.৫-১১ হাজার ডলারের জায়গায় ৩-৩.৫ হাজার ডলার, জেনারেল ম্যানেজার ৬-৮-এর পরিবর্তে ১.৮-২.৫ এবং হেড অব ডায়িং ৫-৭-এর পরিবর্তে ১.৫-২ হাজার ডলার বেতন দেখানো হচ্ছে। সরকারকে কর ফাঁকি দেয়ার জন্য কোম্পানি এবং বিদেশি কর্র্মীদের যোগসাজশে এসব করা হচ্ছে।
যেভাবে থাকছে অবৈধরা : টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়- স্থানীয় বাংলাদেশিরা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমেই বিদেশিদের থাকার ক্ষেত্রে সহায়তা করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের ৮টি সংস্থাকে ২৩-৩৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এর মধ্যে ভিসা সুপারিশ পত্রের জন্য ঘুষ নিচ্ছে ৫-৭ হাজার টাকা, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা সংগ্রহ ৪.২৫ থেকে ৮.৫ হাজার, ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিক ৯০ দিনের বেশি অবস্থানের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের জন্য ২-৩ হাজার, কাজের অনুমোদনের জন্য বিডা, এনজিও ব্যুরো ও বেপজায় ৫-৭ হাজার, নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে পুলিশকে ৫-৭, নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ৩-৫, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২-৩ এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরকে ৩-৫ হাজার টাকা দিতে হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর মানে হল- বিদেশিদের মাধ্যমে টাকা পাচারের একটি পথ তৈরি হয়েছে। টিআইবি যেহেতু বিষয়টি নিয়ে কাজ করে অবৈধভাবে থাকা নাগরিক চিহ্নিত করেছে, বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে টাকা পাচার বন্ধ হবে না।
তথ্য বিভ্রান্তি : বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এক সংস্থা একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে বৈধ বিদেশিদের সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬। এর মধ্যে ব্যবসায়ী ৬৭ হাজার ৮৫৩, বিশেষজ্ঞ ৮ হাজার ৩০০, কর্মকর্তা ৩ হাজার ৬৮২, কারিগরি পেশাজীবী ৭২৭, খেলোয়াড় বা ক্রীড়া সংগঠক ২ হাজার ১০৫, বিনিয়োগকারী ৯২২, ব্যক্তিগত কর্মচারী ৮০৪, এনজিও কর্মী ৫৬১, প্রশিক্ষক/গবেষক ৪০০ এবং গৃহকর্মী ১৩২ জন। এদের মধ্য থেকে ব্যবসায়ী বাদ দিলে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ১৭ হাজার ৬৩৩ জন। অন্যদিকে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের তথ্যানুসারে মোট বিদেশি নাগরিক ৩৩ হাজার ৫০৪।
এর মধ্যে ৯ হাজার ৬৬১ জন ব্যবসায়ী ও অন্য পেশায় আছেন ২৩ হাজার ৭৮৮ জন। গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে ২ লাখ ১২ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এরা প্রতিবছর ৫-১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রায় ৪২ হাজর ৫০০ থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, প্রতিবছর বিদেশিরা ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এই উন্নয়নে সুফল কারা পাচ্ছে সেটি বিবেচ্য বিষয়। তিনি বলেন, সংস্থার রিপোর্টে দেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। আর আগে আমরা একটি প্রতিবেদনে বলেছিলাম, বর্তমানে ৬টি দেশে ভিসা বিনা মূল্যে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই ভিসার জন্য প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের ঘুষ দিতে হচ্ছে। এতে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বিদেশি নাগরিকরা নিয়ে যাচ্ছেন কমপক্ষে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে ৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য টিআইবিই দিচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৪৮ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, অভিবাসীদের জোগানদাতা হিসেবে বিশ্বে পরিচিত বাংলাদেশ। অর্থাৎ আমরা বিদেশে শ্রমিক সরবরাহ করি। কিন্তু বাংলাদেশে লাখ লাখ বিদেশি কাজ করছেন। এর সব বৈধভাবে হলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা অনেক এগিয়ে যেতাম। তিনি বলেন, অবৈধ বিদেশি নাগরিক কাজ করার ক্ষেত্রে আইন রয়েছে। এ আইনের প্রয়োগ নেই। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আশির দশকে তৈরি পোশাক এবং পরবর্তী সময়ে ওষুধ, চামড়া, সার, সিমেন্ট, মোবাইল ফোন, বিদ্যুৎ শিল্প ও সেবা খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কাঠামো শিল্প ও সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। আর শিল্প বিকাশের স্বার্থে ওই সময়ে সরকার বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব বিভিন্ন নীতিগত প্রণোদনা দেয়। যা বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি কর্মীদেরও আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন শিল্পের শুরুর দিকে বাংলাদেশে কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি ছিল।
এ কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে সংশ্লিষ্ট খাতের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী দিয়ে পূরণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ওই ঘাটতি কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশি যুবকদের মধ্যে বেকার সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে শিক্ষিতদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই বেকার। সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি শ্রমিক বাড়ছে। এতে কর্মসংস্থান আরও সংকুচিত হচ্ছে। চার দশক আগে বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্প বিকাশের সময় যে বিদেশি কর্মী প্রয়োজনীয় ছিল, বর্তমানে তার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার যুগান্তকে বলেন, ভিসার বিষয়টি শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসে না। এ জন্য অনেকগুলো সংস্থা আছে। তিনি বলেন, কাজের অনুমোদনের বিষয়টি এনজিও ব্যুরোসহ অন্যান্য সংস্থা দেখে। এ জন্য আমাদের কাছে আসতে হয় না। তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে অবস্থান করা কেউ ধরা পড়লে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফলে এই বিষয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জড়ানো ঠিক নয়।