Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি প্রধান দুই ঘাতক

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রিফাতের স্ত্রী মিন্নির

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরগুনা থেকে

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০১৯, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

রিফাত শরীফ (বায়ে)। ফাইল ছবি

বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যার পাঁচ দিনেও প্রধান দুই ঘাতক নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। রোববার সংবাদ সম্মেলনে বরগুনার পুলিশ সুপার এ হত্যার ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানালেও তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি মাত্র দু’জন। এরা হল মামলার ৪নং আসামি চন্দন এবং ৯নং আসামি মো. হাসান। গ্রেফতার হওয়া বাকি ৪ জনের মধ্যে নাজমুল হাসানকে ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করা হয়। আর তানভির, সাইমুন এবং সর্বশেষ রোববার গ্রেফতার হওয়া সাগরের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই বলছে না পুলিশ। শুধু বলা হচ্ছে, সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া শনিবার রকিবুল ইসলাম রিফাত নামে আরও একজনকে গ্রেফতারের কথা বলা হলেও এদিন পুলিশ তার নাম বলেনি।

ধারণা করা হচ্ছে, দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হওয়া এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট চাপ সামলাতে যাকে তাকে গ্রেফতার করছে বরগুনার পুলিশ। এর মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও বোঝানো হচ্ছে অগ্রগতি হচ্ছে মামলার তদন্ত এবং আসামি গ্রেফতারে। যদিও এতে খুশি নন বরগুনার সাধারণ মানুষ। প্রধান দুই ঘাতকসহ মামলার অন্য আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় জনঅসন্তোষ বাড়ছে ক্রমেই। পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে প্রশ্নের। এমনিতেই এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরুর দিকে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা না থাকার অভিযোগ রয়েছে সর্বমহলে। হত্যাকাণ্ডের দিন ২৬ জুন তাৎক্ষণিকভাবে আসামি গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হলে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী ধরা পড়ত বলে মনে করছেন অনেকে।

এদিকে মামলার ১নং আসামি নয়ন বন্ডের আসল বাড়ি যে বরগুনায় নয়, সেটাও পত্রিকায় খবর বেরোনোর আগে জানত না পুলিশ। ফলে রিফাতকে খুন করার পর বুধবার রাতে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলায় লুকিয়ে থাকার সুযোগ পায় নয়ন। পরদিন সেখান থেকে পালিয়ে সে চলে যায় উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে। চেষ্টা চালায় হিলি এলাকার সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার। যদিও আগে থেকেই সীমান্তে রেড অ্যালার্ট থাকায় তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

তদন্তে গাফিলতি নাকি প্রভাবশালীদের চাপ : ৮-১০টি মামলার আসামি এবং চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী-সন্ত্রাসী হওয়া সত্ত্বেও বরগুনা শহরে বীর দর্পে ঘুরে বেড়াত সন্ত্রাসী গ্রুপ ০০৭-এর লিডার নয়ন বন্ড এবং তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড রিফাত ফরাজী। তাদের এভাবে প্রকাশ্যে বিচরণ আর ক্ষমতার দাপট দেখানো প্রশ্নে যাদের নেপথ্য সহযোগিতার কথা বারবার উঠে এসেছে তারা হলেন- বরগুনা সদর আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সুনাম দেবনাথ এবং রিফাত ফরাজীর আপন খালু সাবেক এমপি ও বরগুনা জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। এই দুই প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়াতেই নয়ন বন্ড-রিফাত ফরাজী ও তাদের বাহিনী বরগুনায় দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করত বলে বলছেন সবাই। যদিও প্রভাবশালী এই দুই রাজনৈতিক নেতা ওই দুই সন্ত্রাসীর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন।

এ ব্যাপারে সুনাম দেবনাথ বলেছেন, সন্ত্রাস এবং মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে নয়ন ও রিফাতকে বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু পরে থানা থেকে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন রিফাতের খালু দেলোয়ার হোসেন। অপরদিকে দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, রিফাতের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কেউ একটা প্রমাণও যদি দিতে পারে তবে রাজনীতি ছেড়ে দেব। এদিকে নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ড প্রশ্নে কোনো মহলের চাপ বা প্রভাব বিস্তারের কোনো বিষয় রয়েছে কি না, জানতে চাইলে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন এবং বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা ছাড়া আর কোনো চাপ নেই পুলিশের ওপর। তাহলে কেন অগ্রগতি হচ্ছে না নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের? মূল আসামিরাই বা কেন পড়ছে না ধরা? এখন পর্যন্ত ৬ আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত মাত্র দুজন। বাকি চারজনের মধ্যে সাগর, তানভির এবং সাইমুন হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে ছিল না। হত্যা মামলার আসামি রাব্বির জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে স্ত্রীর জন্য সিম কেনায় গ্রেফতার করা হয়েছে সাইমুনকে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এদের সংশ্লিষ্টতা কী, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট করে কিছু বলছে না পুলিশ। রোববার জেলা পুলিশের প্রেস ব্রিফিং চলাকালে এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হয় পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের কাছে। গ্রেফতারকৃতদের এক কথায় সন্দিগ্ধ বলে তিনি এড়িয়ে যান সবকিছু। সেই সঙ্গে নয়ন বন্ডের বাড়ি যে দশমিনায় সেটা পুলিশ আগে থেকেই জানত বলে দাবি করেন তিনি। নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজীসহ মামলার অন্য আসামি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হবে বলেও বলেন তিনি।

নিরাপত্তা শঙ্কায় মিন্নি : চোখের সামনে স্বামী রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করতে দেখেছেন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। খুনিদের ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। ভুল বুঝে স্বামী রিফাতের বন্ধুদের দেয়া বাধার কারণে শেষবারের মতো দেখতে পারেননি স্বামীর মুখও। সমুদ্র সমান কষ্ট বুকে নিয়ে অনেকটাই পাথর হয়ে গেছেন তিনি। তারপরও কোনো সংবাদকর্মী কিংবা প্রশাসনের কাউকে কাছে পেলেই করেন একটাই দাবি- ‘স্বামী হত্যার বিচার চাই আমি, যারা ওকে আমার চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।’

মিন্নির সঙ্গে কথা হয় শনিবার তার বাড়িতে। স্বামীকে হারিয়ে অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন। চেহারায় হতবিহ্বল ভাব। যুগান্তরকে মিন্নি বলেন, পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও ব্যক্তিগতভাবে রিফাতের সঙ্গে আমার পরিচয় জানা-শোনা আরও ৩-৪ বছর আগে। নয়ন বন্ড যে আমায় বিরক্ত করত তা জানত রিফাতও। জোর করে অস্ত্র ঠেকিয়ে একটি বইয়ে স্বাক্ষর নেয়া, পথেঘাটে আমায় বিরক্ত করা, জোর করে আমার রিকশায় উঠে বসা, এসবই আমি আমার স্বামীকে বলেছি। তাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার পর এখন সেই ঘটনাগুলোকে ভিন্নভাবে সামনে এনে হত্যাকারীদের বাঁচানোর ষড়যন্ত্র চলছে। আমার কারণে নয়নকে খুন করা হয়েছে, এটা প্রমাণ করা গেলে হত্যাকাণ্ডটি জায়েজ হবে বা এর গুরুত্ব কমে যাবে এমনটাই মনে করছে ষড়যন্ত্রকারীরা। তাছাড়া খুনি নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজীর পেছনে বড় বড় রাজনৈতিক নেতার হাত আছে। তারা তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আর আমাকে চরিত্রহীন বানানোর চেষ্টা চলছে। আমি নিজে এবং আমার পরিবারও চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি। আমার একটা ভাই আছে। তাকেও একবার হুমকি দেয়া হয়েছিল। আমি হত্যাকারীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি চাই।

এদিকে রিফাত হত্যার বিচার এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে রোববার বরিশালে মানববন্ধন হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বরিশাল জেলা শাখার উদ্যোগে এ মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন ফ্রন্টের জেলা সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক সাগর। বক্তব্য দেন জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক নিলিমা জাহান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা আহ্বায়ক হাসিবুল ইসলামসহ অন্যরা।

ঢাকায় টিকটক হৃদয় গ্রেফতার : রিফাত হত্যার অন্যতম আসামি টিকটক হৃদয়কে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি দল। রোববার বিকালে পিবিআইয়ের (এসআইএন্ডও) ইন্সপেক্টর ওয়ালী উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করেছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। টিকটক হৃদয় রিফাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১২ নম্বর আসামি। সে ঢাকায় এসে এক প্রভাবশালী আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করেছিল। তবে এ বিষয়ে পিবিআইয়ের কোনো কর্মকর্তা কোনো কথা বলছেন না। পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে কোনো কথা বললে ডিআইজি স্যারই বলবেন। ডিআইজি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে চেষ্টা করা হলে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এদিন দুপুরে জেলা পুলিশের কার্যালয়ে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অগ্রগতি নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন। এ সময় তিনি ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান। এরা হল : মামলার ৪নং আসামি চন্দন, ৯নং আসামি হাসান, সন্দিগ্ধ আসামি নাজমুল হাসান, তানভির, সাইমুন ও সাগর। এদের মধ্যে সাগরকে রোববার এবং তানভির ও সাইমুনকে শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাগর পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। রোববার ছিল তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে নির্ধারিত দিন।

পটুয়াখালীতে মানববন্ধন : পটুয়াখালী (দক্ষিণ) প্রতিনিধি জানান, রিফাত হত্যার বিচার এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে পটুয়াখালীতে মানববন্ধন করেছে ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন পটুয়াখালী জেলা শাখা। রোববার বিকালে ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে সংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।

গ্রেফতার ও সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারির নির্দেশনা চেয়ে রিট : বরগুনায় রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ও সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারির নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন এক আইনজীবী। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ রোববার হাইকোর্টর সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন। রিটে দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না এই মর্মে রুলও চাওয়া হয়েছে। আইনজীবী জানান, আজ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে রিটটি উপস্থাপন করা হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম