জীবনের শেষ সম্বল ছিল হাতের একটি আংটি আর গায়ের কম্বল : রবি চৌধুরী

হাসান সাইদুল
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নব্বই দশকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রবি চৌধুরী
নব্বই দশকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রবি চৌধুরী। অডিও অ্যালবামের বাইরে চলচ্চিত্রেও তিনি জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন। নতুন গানে বর্তমানে খুব একটা দেখা যায় না তাকে। তবে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত।
শো করে বেড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশে। সঙ্গীতাঙ্গনে তিন দশকের বেশি সময় কাজ করছেন। দীর্ঘ পথ চলায় অনেক বাঁক বদল দেখেছেন এ শিল্পী। শূন্য থেকে আজকের এ অবস্থানে আসার গল্প বলেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। -
যুগান্তর: অনেকের ধারণা আপনি গান থেকে দূরে রয়েছেন...
রবি: মোটেও দূরে নই। বর্তমান সঙ্গীতাঙ্গন এবং দর্শকমহলে একটি ভুল রীতি দেখতে পাচ্ছি- টেলিভিশনের পর্দায় নিয়মিত থাকতে হবে। নিয়মিত গান বের করতে হবে, না হয় হারিয়ে গেছে। গান বন্ধ করে দিয়েছি বা জনপ্রিয়তা কমে গেছে, এটি ভাবা ঠিক নয়।
আমার ভেতর থেকে গান এলে আমি গান করব। আর সে গান নিয়ে কাজ করব। কারণ ছাড়া পত্রিকায় নিউজ হওয়ার কোনো মানে নেই। আর আমি কাজে বিশ্বাসী। মানুষ আমার গানকে ভালোবাসেন। এ ভালোবাসায় আমি বেঁচে আছি।
যুগান্তর: বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?
রবি: এখন কনসার্টের ব্যস্ততা কম। টেলিভিশনেও আমি কম যাই। নতুন একটি অ্যালবামের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। চেষ্টা করছি এ বছর আমার ৬৫তম অ্যালবাম প্রকাশ করতে। পাশাপাশি একটি গজলের অ্যালবামও বের করার জন্য কাজ করছি।
যুগান্তর: প্লেব্যাকেও আপনাকে এখন আর দেখা যায় না, কেন?
রবি: ৭০ থেকে ৮০টি সিনেমায় গান করেছি বলে মনে হয়। সর্বপ্রথম ‘আন্দোলন’ ও সর্বশেষ নার্গিস আক্তারের পরিচালনায় ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলাম। এরপর কোনো সিনেমায় গান করা হয়নি। এখন তো সিনেমাও কম হয়। ভালো কিছুর অপেক্ষা করছি। দেখা যাক সামনে হয়তো প্লেব্যাক করতেও পারি।
যুগান্তর: সঙ্গীতাঙ্গনের একাল আর সেকালের মধ্যে কী পার্থক্য দেখেন?
রবি: প্রযুক্তির বদৌলতে এখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সময় তা ছিল না। আমাদের মধ্যে শেখার আগ্রহ বেশি ছিল। আমরা শ্রোতাদের ভালোবাসা পেয়েছি, কিন্তু তাতে কখনও গর্ব কিংবা অহঙ্কার করিনি। এখনকার অনেকের মধ্যে তারকা ভাব থাকে বলেই তারা শেষ হয়ে যায়। এটা ঠিক নয়। বর্তমান গানের স্থায়িত্ব কম। গানের কথায় ভালো-মন্দ দুটো থাকলেও সুরের বেলায় কোনো বৈচিত্র্য নেই। মনে হয় ঘুরে ফিরে একই সুরে গান শুনছি। কিন্তু আগের গানে তা ছিল না। গানের কথা, সুর ও শিল্পীর কণ্ঠ সব মিলিয়ে দারুণ লাগত। তাই তো আগের গান কাল জয় করেছে।
যুগান্তর: সঙ্গীতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে কীভাবে দেখছেন?
রবি: প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করব। কিন্তু সেটি কী পরিমাণ ব্যবহার করব তার একটা সীমা থাকা উচিত। আমরা যখন শুরু করি তখন গান একবারেই গাইতে হতো। এখন গান একটি একটি শব্দ করেও গাওয়া যায়! যার ফলে এখন সবাই গায়ক। প্রযুক্তির কল্যাণে বলুন আর যা-ই বলুন, এখন গায়কের অভাব নেই। কিন্তু শিল্পীর বড়ই অভাব। শো করেন, দেখা যাবে কে জমাতে পারে, কে গান গাইতে পারে!
যুগান্তর: গান মানেই তো শোনার বিষয়। কিন্তু এখন সেটি না দেখলে শোনাও হয় না। বিষয়টি নিয়ে কী বলবেন?
রবি: গান মানেই শোনার বিষয়। এটি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। তবে ভিডিও থাকলে এতে দোষের কিছু নেই। সময়ের সঙ্গে প্রতিটি বিষয়ে পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক। গানের ধরন বদলে গেছে। ভালো মন্দ ভিডিও হচ্ছে। কিন্তু যত্রতত্র গানের ভিড়ে ভালো গানের সংখ্যা খুবই কম। এখন শ্রোতারা আরও সহজে গান শুনতে পারছে, এটা ভালো। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহার না হয় সেটিই আমি চাইব।
যুগান্তর: ইউটিউবে ‘ভিউ’প্রথা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রবি: ভিউ আমার কাছে কোনো বিষয় নয়। গানের মান হচ্ছে মূল বিষয়। একজন শিল্পীর গান যদি ভালো হয় শ্রোতারা তা শুনবেনই। এবং নিজে নিজে গেয়ে উঠবেন। এখন ভিউ নিজেও বানানো যায় এটিও পরিষ্কার। শ্রোতাদের ফাঁকি দেয়ার কোনো উপায় নেই।
যুগান্তর: এমন কোনো স্মৃতি আছে যা এখনও মনে পড়লে কষ্ট হয়?
রবি: কষ্ট নয়। আমার ভালোই লাগে। গ্রামের একটি প্রবাদ আছে, ‘থালা বাটি কম্বল, শেষ সম্বল’। আমার শেষ সম্বল ছিল একটি কম্বল। হাতের একটি সোনার আংটিও ছিল। এ দুটি জিনিস বিক্রি করেই আমার প্রথম অ্যালবাম তৈরি করি। কিন্তু কোনো কোম্পানি আমার অ্যালবামটি নিতে চায়নি। অবহেলা করেছে। চলবে না বলেও ধিক্কার দিয়েছে। শেষ বার ‘সেলেক্স’ নামে একটি কোম্পানি আমার অ্যালবাম প্রকাশ করতে রাজি হয়েছিল। এর পরের গল্পটি তো সবারই জানা। বলা চলে শেষ কম্বলটিই আমার বর্তমান অবস্থানের সব সম্বল বানিয়ে দিয়েছে। এগুলো প্রায়ই মনে পড়ে। হাসি, কাঁদিও। এই তো জীবন।
যুগান্তর: আপনাকে তো একবার স্টেজে গাইতে দেয়া হয়নি...
রবি: এটা নব্বই দশকের কথা। তখন গান শুরু করি মাত্র। মালেশিয়ায় একটি শোয়ের ঘটনা। দু’দিনব্যাপী সে অনুষ্ঠানে আমার প্রথম দিন গাওয়ার কথা। কিন্তু আয়োজকদের অনেকেই আমাকে গাইতে দেননি। তবে দ্বিতীয় দিন আয়োজকদের মধ্যে পরিচিত কয়েকজন গাইতে দেন আমাকে। আমি ওই দিনই চমক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। প্রথম গান শোনার পর শ্রোতারা আমাকে স্টেজ থেকে নামতে দিতে চাননি। যারা আমাকে স্টেজে প্রথম গান করতে দেননি, তিন চার বছর পর তারাই আমার শিডিউল নিতে আসেন। আমার মনে আছে- ওই সময় আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে শিডিউল নিয়েছিলেন।
যুগান্তর: আগামীর পরিকল্পনা কী?
রবি: একজন শুদ্ধ সঙ্গীতের সেবক হিসেবে কাজ করে যেতে চাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গান গেয়েই যাব। সামনে নচিকেতার কথা ও সুরে ‘ঢাকা মানেই বাংলাদেশ’ নামে একটি মিউজিক ভিডিও দর্শকদের উপহার দেব।