কোনোদিন কাঁদি নাই সেদিনের ঘটনায় যত কেঁদেছি: লুবনা মরিয়ম
লুবনা মরিয়ম একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক কর্মী, সংগঠক, নৃত্য গবেষক ও নৃত্যশিল্পী। লিখেছেন-
শিল্পী নাগ
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একাত্তরের ২৫ মার্চে ঢাকায় গণহত্যার সময় বিডিআর ক্যাম্প মানে পিলখানার কাছাকাছি থাকতেন সপরিবারে। সারা রাত অসহায় মানুষের চিৎকার শুনেছেন। ২৬ ও ২৭ মার্চ কারফিউ ছিল। কারফিউ উঠলে তার বাবা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে অবস্থা দেখেন। তাদের বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতারা এলেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, যারা মধুপুর জঙ্গলে চলে গেছেন, তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন না। কারণ তারা কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত হতে চাননি। তাদের কাছে মনে হয়েছিল, এটা বুর্জোয়া একটা প্রতিবাদ বা আন্দোলন। তার বাবা কমিউনিস্ট পার্টির সবার সঙ্গে বিরোধিতা করে বললেন, ‘যেভাবে দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, আমি একজন প্রশিক্ষিত অফিসার। আমাকে যেতেই হবে।’ মেজর কে এম সফিউল্লাহ গিয়েছিলেন মধুপুর জঙ্গলে। তিনি ছিলেন তার বাবার ক্যাডেট। সে জন্য তার বাবা বললেন, ‘ওরা ছোট মানুষ। ওদের সঙ্গে আমাকে যেতেই হবে।’ ২৮ মার্চের দিকে তাদের তিন ভাইবোন আর মাকে টাঙ্গাইলে রেখে চলে গেলেন মধুপুর জঙ্গলে।
সেখানে শুনেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার বাবার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন আত্মীয়স্বজনরা তাদের রাখতে চাইলেন না। কারণ যে কোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যাবে। তারা গান্ধীনা গ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলমের বাড়িতে যান। জুন মাসের দিকে তার চাচা এসে জানালেন, বাবা ব্যবস্থা করেছেন তাদের আগরতলা যাওয়ার। ওয়াহিদ ভাই (ওয়াহিদুল হক) এ কাজগুলো দেখাশোনা করতেন।
লুবনা মরিয়মের মতে, আমরা গান্ধীনা থেকে ঢাকা, তারপর কুমিল্লা হয়ে আগরতলা গেলাম। সেখানে বাবার সঙ্গে জুন মাসে আমাদের দেখা হলো। বাবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। মা সুলতানা সারওয়াত আরা জামান তৃণমূল সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করেছেন। ভারতীয় আর্মিদের সহযোগিতায় কলকাতায় এলাম। আমাদের এক আত্মীয় আবু সাঈদ ও তার স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হলো। তারা ততদিনে সব উদ্বাস্তুদের সহায়তা করছেন। তারা যুক্ত ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর (কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক, বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘ন হন্যতে’) সংগঠন ‘সেন্টার ফর কমিউনাল হারমনি’র সঙ্গে। কল্যাণীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির ছিল। মৈত্রেয়ী মাসি কল্যাণীতে কিছু মেডিকেল সার্ভিস প্রোভাইড করেছিলেন। তিনি আমাদের বললেন, ‘তোমরা দুই বোন ডাক্তারদের সহায়তা কর। আর আমার ভাই নাদিমকে বাবা প্রথমে মেলাঘরে পাঠালেন। বাবা নিজে সেক্টর কমান্ডার হয়ে গেলেন, তখন মেলাঘর থেকে নাদিমকে পশ্চিমের মালদার দিকে নিয়ে এলেন মহদীপুর ক্যাম্পে। আমরা জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কল্যাণীতে ছিলাম আরতী সেন নামে একজনের বাসায়। মৈত্রেয়ী মাসি আবার অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে একটি অনাথ আশ্রম করলেন। অনাথ আশ্রমের নাম ছিল ‘খেলাঘর’। সেখানেও সহায়তা করতাম। আবার সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ডের একটা হাসপাতাল খুলেছিল, সেখানে ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করতাম। কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ ছিল কল্যাণী।
‘ততদিনে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ সংগঠিত হয়েছে। আমার বড় বোন নায়লা, যিনি পরে ডাক্তার হয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী সংস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হলেন। যখনই ওরা ডাকতেন, নায়লা আপা বাসে করে গিয়ে গান গেয়ে ফিরে আসতেন। মাঝে মাঝে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য গান করেছেন।
ওরা ট্রাকে করে একেকটা উদ্বাস্তু শিবিরে গিয়ে গান করত। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা একবার কল্যাণীতে এলো। নায়লা জানাল-ওরা এখান থেকে বহরমপুর লালগোলা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে (৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর) যাচ্ছে। সেখানে নাকি থাকবেও কিছুদিন। লালগোলা ক্যাম্প আমার বাবার অধীনে ছিল। বাবার সঙ্গে বহুদিন দেখা হয়নি, তাই আমিও ট্রাকে উঠে গেলাম। সেই সময়টায় লিয়ার লেভিনের দলটা বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কার্যক্রমের ভিডিও ধারণ করছিল। সে জন্য ‘মুক্তির গান’ (তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র)-এ আমাকে সবাই দেখেছেন। ঘটনাক্রমে ওই পাঁচ দিন আমি ছিলাম ওদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের আরেকটা প্রামাণ্যচিত্র আছে জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’। ওটাতে আমার বাবা আছেন। প্রামাণ্যচিত্রে আজীবনের জন্য থেকে গেলেন।
বাবা সেপ্টেম্বরের দিকে আমার ছোট ভাই নাদিমকে (১৫ বছর) মুক্তিবাহিনীর মহদীপুর ক্যাম্পে দিয়ে দিলেন। আমার মায়ের ভীষণ মন খারাপ হলো। এত ছোট ছেলেকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে। মা মৈত্রেয়ী দেবীর সহায়তায় এক ট্রাক ওষুধসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিলেন। মহদীপুর একটা মেডিকেল সেন্টার করবেন। ডাক্তার মোয়াজ্জেম ও আরেকজন ইন্টার্ন ডাক্তার এলেন ওখানে। ওদের সহায়তায় কাজটা এগোলো, হাসপাতাল হলো। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আহত হচ্ছে। তাদের সেবা-শুশ্রূষার দরকার ছিল।
আমাদের মহদীপুর সাব-সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৪ ডিসেম্বর শহিদ হলেন। আমি জীবনে এত বেশি কোনোদিন কাঁদি নাই, সেদিনের ঘটনায় যত কেঁদেছি। আমি এই ৫০ বছরে অনেকবার চিন্তা করেছি-স্মৃতি কেন বিলীন হয় না। এটা নিয়ে আমি অনেক গবেষণা করেছি। স্মৃতি তো বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। হয় না।
একাত্তরের স্মৃতি আমাদের কাছে সদা বর্তমান। আমরা ভুলতে পারি না। হতে পারে এটা আমাদের ছোট বয়সের একটা ট্রমা ছিল। আসলে ভুলতে পারি না। জাহাঙ্গীর ভাই ১৪ ডিসেম্বর শহিদ হলেন। ১৪ ডিসেম্বর মহানন্দা নদীর তীরে অনেক বড় যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরসহ আরও ৪০ জন শহিদ হয়েছেন। একটা একটা করে মৃতদেহ নিয়ে আসছে-সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ১৬ ডিসেম্বর আমরা রেডিওতে শুনলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন যদিও আনন্দের দিন, আমাদের মন ভেঙে গিয়েছিল।