বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক আন্না কোক্কিয়ারেল্লা
আন্না কোক্কিয়ারেল্লা ইতালিয়ান ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির একজন অনুবাদক। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও একটি বই লিখছেন। তার সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন-

রীতা ভৌমিক
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইতালিতে আমার এক বাঙালি বন্ধু ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী-জন্মবার্ষিকী, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ শুনতেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কী দীপ্ত কণ্ঠ। একটু একটু করে ওই বন্ধুর কাছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানলাম। পরবর্তী সময়ে তার মাধ্যমেই জানতে পারলাম, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে ২০১২ সালের জুনে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী সংকলন বের হয়েছে। বইটিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ’৭৫ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। যিনি দেশের মানুষকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাকেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সেনাবাহিনী তৈরি করেননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের প্রশিক্ষণে যারা সেনাবাহিনী হয়েছিলেন তিনি তাদের ওপর বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি যদি তাদের এড়িয়ে যেতেন তাহলে এভাবে তার মৃত্যু হয়তো হতো না। আমার ইচ্ছে ছিল যিনি দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আমার দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এ ভাবনা থেকেই বইটি সংগ্রহ করে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নিই। বইটি অনেক সময় নিয়ে পড়েছি। পড়তে পড়তে বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি, ঘটনার কথা জেনেছি। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় অনেক দুষ্টু ছিলেন। দরিদ্র মানুষদের সহযোগিতা করার জন্য মানুষের কাছ থেকে চাল-ডাল সংগ্রহ করতেন। বড় হয়ে এ দুষ্টুমিটা তিনি ভালো কাজে লাগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে পড়তেই তার প্রত্যেকটা কাজ সম্পর্কে জানতে পারি। একটু একটু করে আমি তার প্রেমে পড়ি। অনুবাদ করার সময় শব্দ খুঁজতে ডিকশনারির সহযোগিতা নিয়েছি। ‘অটোবায়োগ্রাফিয়া ইনকমপ্লিটা’ নামে বইটি প্রকাশ হবে ইতালি থেকে। বইটি প্রকাশনা পর্যায়ে রয়েছে। এভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা বললেন ইতালির লেখক আন্না কোক্কিয়ারেল্লা ।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অনুবাদ ছাড়াও আন্না কোক্কিয়ারেল্লা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি বই লিখছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অনেক নারী পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন। কিন্তু তারা তা প্রকাশ করেননি। এইসব বিষয়ও উঠে আসবে তার বইয়ে।
আন্না কোক্কিয়ারেল্লার জন্ম ইতালির দক্ষিণের শহর বেনেভেন্তোতে। তার বাবা সেভেরিও ছিলেন কাউন্সিলের একজন সরকারি কর্মচারী। মা মারিয়া একজন গৃহিণী। তারা চার বোন, এক ভাই। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। রোমের ‘ল্যা স্যাপিয়েনজা ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে’ ইসলাম ধর্মের কলা ও ইতিহাস এবং ভারত ও ইরানের ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। হিন্দি, আরবি, তিব্বতি, স্প্যানিশ ও বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় রয়েছে তার গভীর দক্ষতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ভারত, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতিকে জানার আগ্রহে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
আন্না কোক্কিয়ারেল্লা রোমের ‘ল্যা স্যাপিয়েনজা ইউনিভার্সিটি’তে পড়ার সময়ে এক বাঙালি সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সেই বন্ধু তাকে বাংলাদেশে বেড়ানোর আমন্ত্রণ জানায়। তিনি বন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। দেখেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহীদ মিনারে দলে দলে মানুষ সমবেত হচ্ছেন। ফুল হাতে রাস্তায় এত মানুষকে শহিদ মিনারের দিকে যেতে দেখে তার মনে কৌতূহল জাগে। বন্ধুর কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে জানতে চান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। ভাষার জন্য অনেক মানুষ জীবন দিয়েছেন। এমন উদাহরণ পৃথিবীর কোথাও নেই। এসব শুনে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল।
আন্না কোক্কিয়ারেল্লা বন্ধুকে বললেন, যে ভাষার জন্য মানুষ জীবন দেয়, সেই ভাষা আমি শিখব। আমাকে জানতেই হবে। সেই আগ্রহ থেকেই বাংলা ভাষা শিখি।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের একেকটি ঘটনায় আবেগাপ্লুত হলেন তিনি। উঠলেন গেণ্ডারিয়ায় ওই বন্ধুর বাড়িতে। একমাস সেখানে অবস্থান করেন। এই প্রথম ঢাকায় এসে ঢাকাকে ভালোবেসে ফেলেন। গেণ্ডারিয়া এলাকায় খোলা ড্রেন দেখে অবাক হন। অথচ ড্রেনে কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই। ময়লা-গন্ধ নেই। বাংলাদেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালেন। বন্ধুর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সটিটিউটে গিয়ে বাংলা ভাষা কোর্সে ভর্তি হওয়ার খোঁজ-খবর নিলেন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঘুরে ঘুরে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ দেখলেন। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ফিরে যান ইতালিতে।
কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। বাঙালি আরেক বন্ধুকে তিনি বাংলা ভাষা শেখার আগ্রহের কথা জানালেন। তিনি তাকে সাহস দিলেন। ইতালিতে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণগুলো শিখে ফেললেন। দু-একটা কথা বলাও শিখলেন। পরের বছর আবার বাংলাদেশে এলেন। এক মাস ঢাকার মিরপুরে একটি পরিবারের সঙ্গে রইলেন। কিন্তু একটাই সমস্যা হল তার। ওই পরিবারের সবাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাষা কি ভুল শিখছেন! শুদ্ধ ভাষা নয়! তিনি শুদ্ধ বাংলা ভাষা শেখার জন্য ট্র্যাক ধরে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ তিনি সবার সঙ্গে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে চান।
এভাবেই বাংলা ভাষাকে আত্মস্থ করলেন। বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে আপন করে নিয়েছেন সদা হাসিখুশি এ মানুষটি।