সময় থাকতে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিন

ডা. মো. তৌফিকুর রহমান ফারুক
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি পালিত হলো বিশ্ব হার্ট দিবস। এ বছর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘Use Heart, Know Heart’ অর্থাৎ আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে জানুন ও হৃদয় দিয়ে সবার হৃদযন্ত্রের যত্ন নিন। বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষ্যে, আমরা সবাইকে সচেতন করতে পারি, কীভাবে সবার হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায়-তা জানতে পারি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে পারি। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে পারি এবং নিজেকে মানসিক চাপমুক্ত রেখে নিজের হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে পারি। এতে হৃদরোগের প্রকোপ কমতে আসতে সাহায্য হবে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন রাজধানীর মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস মালিবাগ শাখার মেডিসিন, হৃদরোগ ও বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান ফারুক
Use Heart বলতে কিছুটা ভিন্নভাবে চিন্তা করা, যেমন-সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, সাহসের সঙ্গে কাজ করা, অন্যকে সাহায্য করা, হৃদরোগের কারণ ও প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিজেকে সক্রিয় রাখা। কারণ হার্ট শরীরের একমাত্র অঙ্গ, যা যে কেউ শুনতে ও অনুভব করতে পারে। এটা জীবন শুরু ও জীবন শেষের চিহ্ন। হৃদপিন্ডের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা সমগ্র বিশ্ববাসী পরস্পরের সঙ্গে, একসঙ্গে মানুষ হিসাবে যুক্ত হতে পারি। Know Heart মানে Know your numbers-অর্থাৎ যেসব ঝুঁকিগুলোয় হৃদরোগ হয়, সেসব ঝুঁকি জানা ও সেগুলোর পরিমাপ করা। আমরা নিজেদের খেয়াল রাখার পাশাপাশি অন্যদের হৃদযন্ত্র যেন ভালো থাকে ও তাদেরও যেন হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিব সবার কাছে পৌঁছাতে হবে, সবাই যেন হৃদরোগ মুক্ত স্বাস্থ্য অর্জন করতে পারে। এ থিমের বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে-
▶ সব মানবজাতির জন্য, সাম্যাবস্থার দুনিয়া কায়েমের জন্য আমাদের হৃদয় ব্যবহার করতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই যাতে হৃদরোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য সমান সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। মধ্য আয়ের দেশগুলোয় শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি মানুষ, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
▶ আমাদের নিজেদের ও পৃথিবী নামের গ্রহের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য হৃদয় দিয়ে আমাদের প্রকৃতিকে সুরক্ষা করতে হবে। হৃদরোগে আক্রান্ত শতকরা ২৫ ভাগ রোগী বায়ুদূষণে মারা যায়। প্রতি বছর আমরা ৭০ লাখ মানুষ হারাই। তাই বায়ুদূষণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমাতে হবে, সেজন্যে আমাদের যাতায়াতে গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে, বেশি হাঁটতে বা সাইকেল ব্যবহার করতে হবে। বায়ুদূষণ সংক্রান্ত আইন যাতে যথাযথ প্রয়োগ হয় সে ব্যাপারেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
▶ নিজের যোগ্যতার পুরোটা যাতে সদ্ব্যবহার করা যায়, সেজন্যে নিজের হৃদযন্ত্রের যত্ন নিজেকেই করতে হবে। মানসিক চাপ আমাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাল ঘুম, আমাদের মানসিক চাপ অনেকটা কমায়। ক্ষতিকর ও অস্বাস্থ্যকর পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও বদ অভ্যাস পরিহার করে আমরা আমাদের হৃদযন্ত্রেকে সর্বোচ্চ ভালো রাখতে পারি।
▶ হৃদরোগ প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কিছু নিয়মের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে-ভাত, রুটি বা বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল্স প্রতিদিন খেতে হবে ২৭০-৪৫০ গ্রাম যা, ৯-১৫ সার্ভিংস্রে সমান, এর মধ্যে ৮-১২ সার্ভিংস ভাত ও ১-৩ সার্ভিংস আটার রুটি হলে ভালো।
ভাত বা রুটির সঙ্গে প্রতিদিন শিম জাতীয় সবজি বা মাছ, মাংস বা ডিম খেতে হবে যা উন্নতমানের খাদ্যমান নিশ্চিত করবে। ভাতের মাড় ফেলে দেওয়া উচিত নয় বা মাড় গালা উচিত নয়, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন আছে। লাল চালের ভাত, বাদামি আটা থেকে তৈরি রুটি খাওয়া ভালো, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, স্নেহ, ফাইবার, খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন বিদ্যমান। প্রতিদিন ১-৪-টি মাঝারি আকারের মাছের বা মাংসের টুকরা বা পোলট্রির টুকরা খাওয়া উচিত এবং অর্ধেক কাপ ডাল খাওয়া ভালো। সিরিয়ালসজাতীয় খাবার (শস্যজাতীয় খাবার) ও শিমজাতীয় খাবারের অনুপাত হওয়া উচিত ৩ঃ১। প্রতিদিন ২টি মৌসুমি ফল, ১টি টক জাতীয় ফল ও ১টি ভিটামিন ‘এ’ আছে এমন ১টি ফল খাওয়া উচিত। খাবার পর ১টি লেবু বা টক জাতীয় ফল খাওয়া ভালো; যা শরীরে আয়রণ বা লোহা শোষণে সাহায্য করবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ গ্রাম টাটকা পাতা যুক্ত ও ২০০ গ্রাম পাতা ছাড়া সবজি খাওয়া ভালো। ১কাপ সমান ১৫০ মিলি দুধ বা ১০০ মিলি দুধ থেকে তৈরি খাবার যেমন দই খাওয়া উচিত যা আমাদের ক্যালসিয়াম সরবরাহ করবে সুস্থ হাড় ও দাঁতের জন্য। যদি দুধে সমস্যা হয় বা ডায়রিয়া হয় তবে সেক্ষেত্রে দই বা সয়া দুধ খাওয়া যেতে পারে, দইয়ের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকে যা দুধের ল্যাকটোজ হজমে সহায়তা করে, বয়স্ক মানুষের জন্য ননীতোলা দুধ খাওয়া ভালো। ঘি, মাখন ও পাম তেলের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জাত তেল যেমন-সয়াবিন ও সরিষার তেল রান্নায় ব্যবহার করা উচিত। প্রতিদিন ১জন মানুষের জন্য রান্নায় ৩০ গ্রামের বেশি তেল ব্যবহার করা ঠিক নয়। বেশি ভাজা খাবার ও তৈলাক্ত খাবার কম খেতে হবে। বেশি চর্বিযুক্ত বেকারি খাবার যেমন-কেক, পেস্ট্রি, ফাস্টফুড যেমন-হটডগ, বার্গার,পিৎজা, রিচ ফুড-বিরিয়ানি, কাচ্চি, প্রক্রিয়াজাত মাংস, গ্রিলড মুরগি কম খেতে হবে, কারণ এগুলোতে ট্রান্স চর্বি বেশি থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রতিদিন ১ চামচের বেশি খাবার লবণ খাওয়া যাবে না। শুধু আয়োডিনযুক্ত লবণ খেতে হবে। উচ্চলবনাক্ত খাবার যেমন-চিপস্, বিস্কুট, ওয়েফার, চকলেট কম খেতে হবে। প্রতিদিন ৬ চামচের বেশি চিনি খাওয়া যাবে না। মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার, ডেজার্ট কম খেতে হবে। মিষ্টি ফলে প্রাকৃতিক সুগার থাকে যা স্বাস্থ্যকর। যেসব খাবারে সুগার বেশি বা লুকায়িত চিনি থাকে যেমন-কনফেকশনারী খাবার , বিস্কুট, কেক, জ্যাম, জেলি , চকলেট, টফি, ক্যান্ডি, মার্মালেড কম খেতে হবে। প্রতিদিন ১.৫-৩.৫ লিটার (৬-১৪ গ্লাস) পানি পান করা উচিত। কার্বোনেটেড পানীয় যেমন কোক, ফান্টা , স্প্রাইটের পরিবর্তে ডাবের পানি পান করা ভালো। যেসব খাবার সহজে পচে যায় তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করে খাওয়া উচিত।
খাবারে, মাছি ও ময়লা থেকে সাবধান রাখার জন্য সব সময় ঢেকে রাখতে হবে।
রাস্তার খাবার না খাওয়া ভালো, কারণ এখানে প্রচুর ধূলাবালি খাবারে থাকতে পারে। আদর্শ ওজন বজায় রাখতে হবে। কমপক্ষে ৩০-৫০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে, যেমন-জোরে হাঁটা, দৌড়ানো, সাতার, সাইক্লিং এবং গৃহস্থালীর কাজকর্ম করা ভালো। বিএমআই (১৮.৫-২৫)-এর মধ্যে রাখতে হবে। কোমরের মাপ ছেলেদের ক্ষেত্রে ৯০ সেন্টিমিটার ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮০ সেন্টিমিটারের নিচে রাখতে হবে। আদর্শ কোমর ও হিপের অনুপাত বজায় রাখতে হবে (ছেলেদের ক্ষেত্রে ০.৯ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ০.৮)। যখনই সম্ভব, খাবারো পর কিছুক্ষণ হালকা কাজ বা হাঁটা ভালো। সময়মত খাবার খেতে হবে ও অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাবার সময় ভাল করে চিবিয়ে খেতে হবে। স্টীমড্ খাবার স্বাস্থ্যকর ও উপকারী। তরকারি ও সবজি কাটার আগেই ধুয়ে নেওয়া ভালো। শাকসবজির টুকরা বড় বড় করতে হবে। কাটার পর সবজি ও ফলমূল বাতাস ও পানির সংস্পর্শে না আসা ভালো। খাবার রান্নার সময় ঢাকনি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। সবজি রান্নার সময় অধিক তাপে, কম সময়ে রান্না করতে হবে। খাবার ১ বারের বেশি গরম করা উচিত না। রান্নার তেল বারবার ব্যবহার না করা ভালো। তিনবেলা মূল খাবারের পর পরই ঘুমানো উচিত না। ধূমপান, মদ্যপান , তামাক পাতা , জর্দা, সুপারি পরিহার করতে হবে। প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। বছরে ১/২ বার প্রয়োজনীয় চেকআপ করানো উচিত।