Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: প্রতিকার ও প্রতিরোধ

Icon

ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি বাত রোগ, যা শরীরের গিরা ও অন্যান্য অঙ্গকে আক্রান্ত করে। এ রোগ লঘুমাত্রা থেকে তীব্রমাত্রা পর্যন্ত হতে পারে। লঘুমাত্রা যদিও সামান্য কষ্টের কারণ হতে পারে, তবে তীব্রমাত্রায় অঙ্গবৈকল্য বা বিকলাঙ্গতা পর্যন্ত গড়াতে পারে। এ বাত রোগের সম্পূর্ণ আরোগ্য হয় না, তবে আধুনিক ও যথার্থ বা উপযুক্ত চিকিৎসায় ব্যথার উপশমসহ শারীরিক বিকলাঙ্গতা ঠেকানো যেতে পারে। এ নিয়ে লিখেছেন ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ এবং অর্থোপেডিক্স ও ট্রমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল

এটি একটি বাত রোগ, যা শরীরের গিরা ও অন্যান্য অঙ্গকে আক্রান্ত করে। এ রোগ লঘুমাত্রা থেকে তীব্রমাত্রা পর্যন্ত হতে পারে। লঘুমাত্রায় যদিও সামান্য কষ্টের কারণ হতে পারে, তবে তীব্রমাত্রায় অঙ্গবৈকল্য বা বিকলাঙ্গতা পর্যন্ত গড়াতে পারে। এ বাত রোগের সম্পূর্ণ আরোগ্য হয় না, তবে আধুনিক ও যথার্থ বা উপযুক্ত চিকিৎসায় ব্যথার উপশমসহ শারীরিক বিকলাঙ্গতা ঠেকানো যেতে পারে।

* কাদের হয়

সচরাচর ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকদের মাঝে প্রকোপ বেশি, তবে বৃদ্ধ বয়সেও এর প্রকোপ তেমন কম নয়। এ বাত শিশুদেরও আক্রান্ত করে। এ রোগের প্রকোপ পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে তিনগুণ বেশি এবং ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এমন বয়সে এটা হয় যখন পরিবার তথা কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত ঘটে আশঙ্কাজনকভাবে।

* কারণ

সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। জীবাণুজনিত কারণ নির্ণয়ের অনেক অনুসন্ধান আজও সফলতার মুখ দেখেনি। মনে করা হচ্ছে, জন্মগতভাবে কেউ এ রোগ হওয়ার কারণ বহন করলে এবং শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রাকৃতিক কোনো কারণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে উসকে দিলেই কেবল এ রোগের সূত্রপাত হতে পারে।

* বাতে শরীরে কী হয়

শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রয়োজনাতিরিক্তভাবে কাজ করা শুরু করে, তখনই এ রোগের সূত্রপাত হয়। কেন এমন হয় তা আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি। এ রোগে ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের শরীরের অঙ্গ তথা গিরা বা জয়েন্ট এবং গিরার আশপাশের কোষ বা কলাকে আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে গিরা বা জয়েন্টের পাতলা আবরণী বা সাইনোভিয়াল মেমব্রেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রদাহ জয়েন্টে অতিরিক্ত রস নিঃসরণ করে, ফলে জয়েন্ট ফুলে যায়। ফুলা ও প্রদাহ দুই-ই ব্যথার জন্য দায়ী এবং চলমান প্রদাহ সময়ে অস্থি বা কার্টিলেজ ধ্বংস করে, যা গিরা বা জয়েন্ট বিকলাঙ্গ করতে পারে।

* উপসর্গ

▶ হাত-পায়ের গিরাগুলো, হাঁটু, কাঁধ কনুই ও হিপ জয়েন্টসহ আশপাশে ব্যথা হওয়া। স্বভাবত শরীরের ডান ও বাম পাশ সমভাবে আক্রান্ত হয়, যা এ রোগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

▶ সকালবেলা বা বিশ্রামের পর গিরা বা জয়েন্ট জাম হয়ে থাকে।

▶ গিরা বা জয়েন্ট ফুলে যাওয়া। বিশেষভাবে হাত-পায়ের গিরা ও হাঁটু।

▶ সব সময় ক্লান্তি বা অবসাদ ভাব।

▶ পেশিতে বল কম পাওয়া এবং গিরায় জাম ধরে থাকায় শারীরিক কার্যক্ষমতার অবনতি।

▶ ব্যথার জন্য রাতে ঘুমাতে না পারা।

এ রোগের সূত্রপাত ক্রমান্বয়ে হতে পারে, আবার হঠাৎ তীব্রমাত্রায়ও হতে পারে। এটা কঠিন অবিরাম রোগ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সারাজীবন ভুগতে হতে পারে। তবে কেউ কেউ কিছু সময়ের জন্য উপসর্গমুক্ত থাকতে পারে। উপসর্গমুক্ত অল্প দিন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে একবার আক্রান্ত হওয়ার পর আর না-ও হতে পারে।

* শুধু গিরা বা জয়েন্টই কি আক্রান্ত হয়

জয়েন্ট ছাড়াও ত্বক, ফুসফুস, হার্ট, রক্ত, স্নায়ুতন্ত্র, চোখ, পরিপাকতন্ত্রসহ অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেও আক্রান্ত করে। তীব্রমাত্রায় ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে উপরি উক্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

* রোগ নির্ণয়ের উপায়

প্রথমত দরকার যথোপযুক্ত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। একজন এমবিবিএস বা জেনারেল প্র্যাকটিশনার পরীক্ষা করতে পারেন। তবে রিউমাটোলজিস্ট হলেন উপযুক্ত চিকিৎসক, কেননা যথার্থ শরীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্য বাত বা আর্থ্রাইটিস রোগ হতে এ রোগকে আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে।

কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনসিস সহজ নয়। তাই রক্ত পরীক্ষা করতে হতে পারে। এ রোগে রক্তের ইএসআর এবং সিআরপি বেশি হয়। প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর পজিটিভ বা বেশি পাওয়া যায়। এক্স-রে এ রোগ নির্ণয়ের জন্য আবশ্যক নয়, তবে এটা যেমন রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে, তেমনি কার্টিলেজ বা অস্থিসন্ধির ক্ষতি হয়েছে কি না বা গিরা বিকল হচ্ছে কিনা তা নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

* চিকিৎসা ব্যবস্থা

এ রোগ সম্পর্কে শিক্ষা, সঠিক ওষুধ প্রয়োগ, ব্যায়াম, পরিমিত বিশ্রাম ও কীভাবে জয়েন্ট বা গিরাকে রক্ষা করা যায় তার শিক্ষাই কেবল দিতে পারে যথার্থ চিকিৎসাব্যবস্থা। এটি একটি সমন্বিত কার্যক্রম, ঔষধি চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত রিউমাটোলজিস্ট বা বাত ব্যথা রোগ বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট, শিক্ষা ও অন্যান্য অঙ্গে প্রশিক্ষিত সেবিকা, রিহেবিলিটেশন বিভাগ এবং কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন।

* নিজেকে সাহায্য করা এবং শিক্ষা

এ রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা একটি দৈনন্দিন কার্যক্রম। জীবন ও শরীরের চাহিদানুযায়ী সর্বদা পুনর্বিন্যাস জরুরি। অনুসন্ধান বা রিসার্চে দেখা গেছে, রোগীর রোগের প্রতি মানসিকতা ও চিকিৎসায় জড়িতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা অতিব জরুরি। এ রোগের রোগীদের অবশ্যই এ রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সার্বিক ধারণা থাকা জরুরি। এ ধারণা বা তার ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং কীভাবে নিজেকে সাহায্য করা যায় তা-ও জানা দরকার। নিজেকে সাহায্য করা বলতে বোঝায় এ রোগের দৈনন্দিন যত্নআত্তি করার দায়িত্ব গ্রহণের শিক্ষা এবং দায়িত্ব পালনে নিজেকে আগ্রহী করে তোলা।

* শিক্ষার মূল বিষয়

▶ ব্যথার উপশম কীভাবে করা যায়, তথা গরম ও ঠান্ডা প্যাকের ব্যবহার।

▶ অশান্তি উপশম, বিবেচনা বোধ ও দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়ার শিক্ষা।

▶ নিজেকে নিরুদ্বেগ করা বা বিনোদন শিক্ষাসহ গভীর শ্বাস ও বিশেষ ব্যায়াম সম্পর্কে জানা।

* ওষুধ বা মেডিকেশন

প্রথম সারির ওষুধ, যেমন-ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি মেডিকেশন যা ব্যথা, ফোলা ও গিরার জাম কমাতে সাহায্য করে।

* প্রচলিত ওষুধ

▶ Naproxyn ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন।

▶ Diclofenac sodium ৫০-১০০ মিলিগ্রাম দু-তিনবার প্রতিদিন।

▶ Indomethacin ২৫ মিলিগ্রাম দু-তিনবার প্রতিদিন।

▶ Piroxicam ১০ থেকে ২০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন।

উল্লেখ্য, উপরি উক্ত ওষুধগুলো জ্বালাপোড়া, বুকজ্বলা, পাতলা পায়খানা বা পায়ে পানি নামার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। আহারের মাঝে বা আহারের পরপরই খেলে আন্ত্রিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। তবে কারও হলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।

গ্যাস্ট্রিক বা আলসার আছে, এমন রোগীদের বেলায় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। কেননা এ ক্ষেত্রে অন্ত্রে ফুটা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণমাত্রায় প্যানটোপ্রাজল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বেলায় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

এ রোগের তীব্রতা ও জটিলতা কমাতে এখন অনেক ওষুধ আছে। রোগের তীব্রতা ও অবস্থা অনুযায়ী সেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

* বিশ্রাম ও ব্যায়াম

ওষুধের পর বিশ্রাম ও ব্যায়াম জরুরি। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ফিজিওথেরাপিস্টরা এ বিষয়ে সাহায্য করেন। বিশ্রাম ফোলা, ব্যথা, ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে।

কাজের মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরি। কতটুকু বিশ্রাম প্রয়োজন তা রোগের তীব্রতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কেননা প্রয়োজনাতিরিক্ত বিশ্রাম ভালোর চেয়ে মন্দ করতে পারে। প্রতিদিন নিয়মিত শেখানো বিশেষ ব্যায়াম করা প্রয়োজন, যা পেশিশক্তকরণসহ অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের বিকলাঙ্গতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। গরম পানিতে ব্যায়াম বিশেষ উপকারী।

* গিরা বা জয়েন্ট রক্ষার উপায়

অসুস্থ গিরার ওপর অযাচিত চাপ ওই গিরার আরও ক্ষতি করে। তাই ওই গিরার ওপর চাপ বা ভর কমাতে হবে। বিশ্রাম বা হাঁটার সময় লাঠি বা ক্র্যাচ ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে গিরা রক্ষার জন্য বিভিন্ন সহায়ক ডিভাইস ব্যবহার করা হয়।

* অপারেশন

রিউমাটোলজিস্টের পরামর্শক্রমে গিরার ব্যথা, বিকলাঙ্গতা বা গিরার কাজের ক্ষমতা ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের উন্নয়নের জন্য কিছু অপারেশন করা যেতে পারে।

* খাদ্য

সুষম খাদ্য খাওয়া জরুরি। কেননা তা শরীর রক্ষা ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে। যদিও কদাচিৎ কিছু খাদ্যে কোনো কোনো বাত রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে, কিন্তু অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই বাতের ওপর খাদ্যের কোনো বিরূপ প্রভাব চোখে পড়েনি। তাই বেছে খাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম