পাইলসের আধুনিক চিকিৎসা
অধ্যাপক ডা. একেএম ফজলুল হক
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাইলস বা অর্শ্ব রোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে। পুরুষ অথবা মহিলা সবার এ রোগ হতে পারে। মলদ্বারে যে রোগই হোক না কেন তাকে রোগীরা পাইলস বলে ধরে নেন। আসলে মলদ্বারে বিভিন্ন রোগ হয় যাদের উপসর্গের মধ্যে বেশ খানিকটা মিল থাকার কারণে রোগীদের এই বিভ্রান্তি। যেমন পায়ুপথে রক্ত যায় এমন রোগের মধ্যে রয়েছে পাইলস, ফিস্টুলা, এনাল ফিশার পলিপ, ক্যান্সার, আলসারেটিভ কোলাইটিস, আমাশয় ইত্যাদি।
উপসর্গ : এ রোগে রোগীরা যেসব উপসর্গের কথা বলে থাকেন তা হল পায়ুপথে রক্ত যাওয়া, চুলকানো, গ্যাজ মাংসপিণ্ড, মলদ্বার ফুলে ওঠা, কিছু ঝুলে পড়ছে এমন এবং ব্যথা হওয়া। এতে অনবরত রক্ত যায় না। প্রথম দিকে বছরে একবার, দুবার এরপর মাসে একবার এভাবে আস্তে আস্তে ঘন ঘন রক্ত যায়। রক্ত সাধারণত পায়খানার পর ফোঁটায় ফোঁটায় অথবা নালে যায়। সামান্য রক্ত যাওয়া থেকে অতিরিক্ত রক্ত গিয়ে গভীর রক্তশূন্যতা হতে পারে। অনেক দিন অতিবাহিত হলে মলদ্বারের পাশে মাংসপিণ্ড ফুলে ওঠে। কখনও কখনও বাইরে ঝুলে পড়ে। রোগী নিজে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। আরও বেশি দিন গড়ালে মাংসপিণ্ডটি সব সময় বাইরে ঝুলে থাকে এবং ভেতরে ঢুকানো যায় না। পাইলসে সাধারণত ব্যথা হয় না, তবে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলে তখন ব্যথা হয়।
কারণ : এ রোগের জন্য কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণ দায়ী নয় বরং অনেক কারণেই এ রোগ হতে পারে যেমন- বংশগত, দৈহিক গঠনজনিত, পুষ্টি, পেশা, আবহাওয়া, মানসিক সমস্যা, বার্ধক্য, হরমোনজনিত, খাদ্য ও ওষুধ, গর্ভাবস্থা, ব্যায়াম, অতিরিক্ত কাশি, আঁটশাঁট পোশাক, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয় ইত্যাদি।
পাইলসে কখন ব্যথা হয় : পাইলস যখন রক্ত জমাট বেধে ফুলে তখন প্রচুর ব্যথা হয়। এটি সাধারণত বহিঃস্থিত পাইলসে হয়। বহিঃস্থিত পাইলসে রক্ত যায় না। এ পাইলসের দুটি ধরন আছে।
* একটিতে মলদ্বারের বাইরে বেশ ফুলে থাকে।
* অন্যটিতে কোনো ফোলা থাকে না কিন্তু হঠাৎ করে ফুলে ওঠে এবং ব্যথা হয়। ইন্টারনাল পাইলসেও ফুলে ব্যথা হতে পারে এটি হয় সাধারণত যারা মলত্যাগের সময় খুব কোঁত দেয়, ভারী ওজন তোলে, যারা দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়ের কারণে বারবার টয়লেটে যায় অথবা যারা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কাজ করে যেমন- পাইলট, ট্রাক ড্রাইভার ইত্যাদি।
পাইলসের মতো একই উপসর্গ অন্যান্য কী কী রোগে হতে পারে
পাইলসের মতো একই উপসর্গ হতে পারে এমন রোগের মধ্যে রয়েছে পলিপ, প্রোলাপস বা মলদ্বার ঝুলে পড়া, ক্যান্সার ও এনাল ফিশার। এক্ষেত্রে মলদ্বারের ভেতর বিশেষ ধরনের এন্ডোস্কপি যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করতে হয় যাকে আমরা বলি প্রকটোস্কপি, সিগময়ডস্কপি ও কোলনস্কপি। এ জাতীয় পরীক্ষায় যদি কোনো সন্দেহজনক জিনিস পাওয়া যায় তাহলে বায়োপসি বা মাংস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয় যে এটি ক্যান্সার বা অন্যকিছু। পায়ুপথের বিভিন্ন সমস্যায় এ জাতীয় পরীক্ষা করা একান্ত জরুরি অন্যথায় রোগ নির্ণয়ে ভুলভ্রান্তি হতে বাধ্য। দীর্ঘদিন ভোগার পর যখন এ জাতীয় পরীক্ষা করা হয় তখন দেখা যায় যে ভেতরে ক্যান্সার বা অন্য কোনো রোগ আছে। দীর্ঘদিন দেরি করার কারণে ক্যান্সার জাতীয় রোগের চিকিৎসা দুরূহ হয়ে পড়ে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা : পায়ুপথের ভেতর পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা দরকার যেমন- প্রকটোস্কপি, সিগময়ডস্কপি, কোলনস্কপি, বেরিয়াম এনেমা এক্সরে ইত্যাদি।
চিকিৎসা : পাইলসের রক্ত যাওয়ার কারণ হতে পারে অতিরিক্ত কোঁত দিয়ে পায়খানা করা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া। এ জন্য খাদ্যাভাসের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে, মল নরম করার জন্য ওষুধ খেতে হবে এবং ডায়রিয়া বা আমাশয়ের চিকিৎসা করতে হবে।
যাদের ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম বা ক্রনিক আমাশয় আছে তাদের জন্য দুধ জাতীয় খাবার এবং তৈলাক্ত খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে। মলদ্বারের হাইজিন বা পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করতে হবে। তাই বলে ঘন ঘন সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে তা নয়। বিভিন্ন ধরনের অয়েন্টমেন্ট ক্রিম বা লোশন পাওয়া যায় যেগুলো ব্যবহার করলে সাময়িক উপকার পাওয়া যায়।
সাপোজিটরি : এগুলো ছোট বুলেটাকৃতি ওষুধ যা পায়ুপথের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিতে হয়।
সাধারণত : তিন ধরনের কাজের জন্য সাপোজিটরি ব্যবহার হয়ে থাকে।
* মলত্যাগ ত্বরান্বিত করার জন্য
* শরীরে ওষুধ প্রয়োগের পথ হিসেবে
* পায়ুপথের রোগের চিকিৎসার জন্য।
পাইলস যখন মলদ্বারের বাইরে ঝুলে থাকে : পাইলস যখন বাইরে ঝুলে পড়ে তখন হয় এটি আপনা আপনি ভেতরে ঢুকে যায় অথবা হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হয়। এ অবস্থায়ও এটিকে বিনা অপারেশনে ভালো করা যায় বিশেষ করে রিং লাইগেশন পদ্ধতিতে। কিন্তু এ পাইলস যদি অনবরত বাইরে ঝুলে থাকে তাহলে এতে থ্রম্বসিস বা গ্যাংগ্রিন হতে পারে। এ অবস্থায় দ্রুত অপারেশন করে ফেলাই উত্তম। অপারেশনের জন্য মোট ৩-৪ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।
পাইলসে যখন ব্যথা হয় : অর্শ্ব বা পাইলসে সাধারণত ব্যথা থাকে না কিন্তু যখন আলসার, গ্যাংগ্রিন বা থ্রম্বসিস হয় তখন ব্যথা হয়। এ অবস্থায় সর্বোত্তম চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন।
সিজ বাথ : গরম পানির সেঁক দিলে মলদ্বারের ব্যথা কমে। পানির উষ্ণতা চল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হওয়া উচিত, পানিতে অল্প কিছু লবণ দিয়ে ১০ মিনিট গামলায় কোমড় ডুবিয়ে বসে থাকতে হয়।
রিং লাইগেশন ও অপারেশনের মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকর : এদুটি পদ্ধতির সাফল্য তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়নি কিন্তু যে ক্ষেত্রে পাইলসটি বাইরে ঝুলে থাকত সে ক্ষেত্রে অপারেশন ভালো কাজ দেয়। তবে যখন পাইলস অনবরত বাইরে ঝুলে থাকে বা অন্য রোগের সঙ্গে থাকে তখন সরাসরি অপারেশন করতে হয়।
লেখক : বৃহদান্ত ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ, ইন্টারন্যাশনাল স্কলার, ইডেন মাল্টিকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা
