ঈদে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার

আখতারুন নাহার আলো
প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুসলমানদের বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি হল ঈদুল ফিতর। এক মাস উপবাসের পর আসে এ ঈদ। ঈদ মানেই নতুন পোশাক, ঈদ মানেই সুস্বাদু ও প্রিয় খাবার। ঈদের দিনে মিষ্টিমুখ করা এ ঈদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সুতরাং প্রতিটি বাড়িতেই মিষ্টি ও মিষ্টান্নের ব্যবস্থা রাখতেই হয়। যেমন সেমাই, পায়েস, জর্দা, হালুয়া, পুডিং, কাস্টার্ড, ফালুদা ইত্যাদি। মিষ্টান্নের পাশাপাশি ঝাল ও নোনতা খাওয়ার ইচ্ছা যে মনে জাগে না তা নয়।
তাই তৈরি হয় পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, কাবাব, কালিয়া ইত্যাদি। আবার রুচির পরিবর্তনের জন্য ঈদের দিনে জায়গা করে নিয়েছে চটপটি, ফুচকা, শাসলিক, নুডলস ইত্যাদি। বোধকরি মানুষের ভেতরে সব সময় একটা পরিবর্তনের ধারা বইতে থাকে বলেই মানুষের স্বাদ ও রুচির তারতম্য ঘটছে প্রতিনিয়ত।
এক মাস রোজা রাখার পর ঈদের দিন অনেকেই খাবারের ব্যাপারে স্বাধীনতা অনুভব করেন। এ দিনে যখন যা ইচ্ছা যতটুকু ইচ্ছা খাবার খেলে কোনো অসুবিধা হবে না। বেশি বেশি সুস্বাদু খাওয়ার জন্যই তো ঈদ উদযাপন। কিন্তু এটা কখনোই করা উচিত নয়।
কারণ এক মাসের সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে দেহের বিপাক ক্রিয়া একটা নিয়মের মধ্যে চলে আসে। তারপর হঠাৎ একদিনের অতিরিক্ত খাবার পাকস্থলী সহ্য করতে পারে না। অর্থাৎ পাকস্থলীর এনজাইমগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, পাতলা পায়খানা, বমি, পেট ফেঁপে যাওয়া, পেটে গ্যাস অর্থাৎ পেটের যাবতীয় সমস্যা দেখা যায়। এ জন্য জেনে বুঝে খাবার খাওয়া উচিত।
ঈদের দিনে বিভিন্ন বাড়িতে রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি হয়। মূলত দেখা যায় মিষ্টি খাবার দিয়েই ঈদের সকাল শুরু হয়। সেজন্য যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের জন্য বিকল্প চিনি দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি করলে তারাও ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারেন।
এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিকল্প চিনি পাওয়া যায়। ঝাল খাবারের মধ্যে আছে সাদা পোলাও, মোরগ পোলাও, কাশ্মীরি পোলাও, সবজি পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, মুরগির কোরমা, খাসির মাংসের কোরমা অথবা রেজালা, গরুর মাংসের রেজালা, মুরগির ঝাল মাংস, কোফতা, কাবাব, মুরগির রোস্ট, রুই মাছের কোরমা ইত্যাদি।
এ বছরের ঈদ একেবারেই গরমের ভেতর। প্রচুর ঘামের জন্য পানিশূন্যতার আশঙ্কা দেখা দেবে বলেই প্রতিটি বাড়িতেই শরবতের ব্যবস্থা থাকা উচিত। তবে কার্বোনেটেড পানীয়র পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর পানীয় পান করা উচিত। এছাড়া এ দিনে ফল দিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি করলে খুবই ভালো হয়।
দেশি-বিদেশি টক-মিষ্টি যে কোনো ফলই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। ফল সহজেই হজম হয়। কারণ ফলে আছে লেভ্যুলোজ ও ফ্রুক্টোজ নামক সহজ শর্করা। ফলের চিনি শরীরকে তরতাজা রাখে। আর ফলের আঁশে যে সেল্যুলোজ থাকে তা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
ঈদের রান্নার আয়োজন বিভিন্ন ধরনের ফল দিয়ে করা যায় যেমন- আনারসের জর্দা, ফ্রুট সালাদ, গুড় নারিকেলের পায়েস, গাজরের হালুয়া, আপেল-নাসপাতি পাই। আম-আনারস-তরমুজের পাই, ফলের কাস্টার্ড। ফালুদা, কাশ্মীরি পোলাও, শশার রায়তা, পাকা কলার রায়তা, আনারস মাংস,আপেল মুরগি, ফলের জুস ইত্যাদি। পরিবেশন টেবিলে কয়েক ধরনের ফল রাখা যেতে পারে।
তাহলে পছন্দমতো ফল অতিথিরা নিয়ে খেতে পারেন। এ গরমে ঈদের দিনে ফলের রসের তৈরি পানীয় অতিথিদের বেশ তৃপ্তি দিবে। ফলে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ লবণ রয়েছে। এখন বাজারে প্রচুর আনারস পাওয়া যায়। টক-মিষ্টি ও সুঘ্রাণের জন্য আনারস অনেকেরই প্রিয়। এটা এন্টিবায়োটিক ও প্রদাহবিরোধী কাজ করে। কলায় আছে পটাশিয়াম, শর্করা, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম ও প্যান্টোথেনিক এসিড।
কাস্টার্ডের প্রধান ফলই হচ্ছে কলা। এটা দিয়ে কাশ্মীরি পোলা ও মিল্ক শেকও করা যায়। আপেলে আছে আলফা হাইড্রক্সি এসিড যা ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। আপেলের পেকটিন ও ভিটামিন সি হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে ও কোলেস্টেরল কমায়।
পেকটিন বায়ু দূষণের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। এটি রক্তস্বল্পতা ও ক্লান্তি নিবারণে ভালো কাজ করে। কাঁচা ও পাকা উভয় ধরনের আম দিয়ে এই দিনে শরবত করা যেতে পারে। এছাড়া আইসক্রিমের সঙ্গে আমের টুকরা মিশিয়ে খেলে যেমন উপাদেয় হবে, তেমনি দেহে একটা শীতল আমেজ এনে দেবে। আমে আছে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, শর্করা ও পটাশিয়াম।
ঈদের দিনে অনেকে চালের সেমাইর সঙ্গে নারিকেল দিয়ে থাকেন। আবার ময়দার তৈরি সেমাইতেও নারিকেল দেয়া যায়। নারিকেলের দুধ দিয়ে পোলাও, মাংস, চিংড়ির মালাই কারি করা যায়। নারিকেলে আছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও এমাইনো এসিড। নারিকেলের চর্বি সহজে হজম হয়। নারিকেল বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সাহায্য করে। পেস্তা বাদাম, কিশমিশ খেজুর প্রতিটি খাবারের শোভা ও স্বাদ বাড়ায়।
বাদামে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, ম্যাগনেশিয়াম, প্রোটিন ও অসম্পৃক্ত চর্বি। হৃদরোগীর জন্য বাদাম খুবই ভালো। ঈদের খাবারে ঝাল-মসলা-তেল-ঘি যত কম হয় তত ভালো। যাদের পেটের সমস্যা তারা অল্প মসলার তৈরি কোরমা খেতে পারেন। এটা যেমন উপাদেয় তেমনি সহজপাচ্য। পোলাও-বিরিয়ানি খেতে অসুবিধা হলে পোলাওয়ের চালের ভাত অথবা সেই ভাতকে সামান্য তেল দিয়ে ফ্রায়েড রাইস করেও খাওয়া যায়।
দুপুর ও রাতের খাবারে চাটনি, আচার, সালাদ, লেবু থাকলে ভালো হয়। খাবারের পর টক বা মিষ্টি দই পরিবেশন করা স্বাস্থ্যসম্মত। দই প্রো-বায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এর ল্যাক্টোক্যাসিলাস ভালো ব্যাকটেরিয়াকে উদ্দীপ্ত করে পরিপাক ক্রিয়াকে সহজতর করে।
ঈদের দিনে যত রকমারি খাবারই থাকুক না কেন, খেতে হবে নিজের শরীরের কথা চিন্তা করে। খাবার হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত। সহজপাচ্য ও পরিমিত। পরিবেশিত হবে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নভাবে। খাবার যেন কোনোভাবেই নষ্ট হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। খাবারের টেবিলে একগুচ্ছ তাজা ফুল যেমন আকর্ষণীয় হবে তেমনই এর সুঘ্রাণ মনকে ভালো রাখবে।
লেখক : চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.) বারডেম হাসপাতাল, পপুলার ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, শ্যামলী, ঢাকা