নবান্ন উৎসব
হেমন্ত ঋতুতে কৃষক ঘরে তোলেন আমন ধান। এ ধান নিয়ে কৃষকের ঘরে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। খাওয়া হয় নতুন ধানের ভাত, পিঠা-পায়েস। কেনা হয় নতুন জামাকাপড়। সব মিলিয়ে কৃষকের আনন্দ-উৎসব। লিখেছেন-
গাজী মুনছুর আজিজ
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
হেমন্ত ঋতু আমাদের চতুর্থ ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে এ ঋতু। অর্থাৎ এর আগে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ গেছে। আর সামনে আছে শীত ও বসন্ত। বলা যায় হেমন্ত আসে শীত আসার খবর নিয়ে। আর যারা গ্রামে থাকেন তারা নিশ্চই এরই মধ্যে শীতের আমেজ পাচ্ছেন? অবশ্য নগরে যারা থাকেন তারা হয়তো শীতের আমেজটা এখনো টের পাননি। শীতের আমেজের পাশাপাশি গ্রামে হেমন্ত ঋতুতে আরও অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে। বিশেষ করে অগ্রহায়ণ মাসে। আর সেটি হলো মাঠজুড়ে হলুদ রঙা পাকা ধান, ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক, গোলায় ধান তোলা, বাড়ির উঠানে ধান সিদ্ধ করা-ইত্যাদি।
হেমন্ত ঋতুর পহেলা মাস কার্তিক। আর কার্তিকের শুরু থেকে ধান পাকতে শুরু করে। হলুদ রঙা এ পাকা ধান দেখে খুশি হন কৃষক। এরপর কৃষক সে ধান কেটে গোলায় তোলেন। রেখে দেন বারো মাস খাওয়ার জন্য। নতুন এ ধান গোলায় তোলা উপলক্ষ্যে কৃষকের পরিবারে উৎসবের সৃষ্টি হয়। খাওয়া হয় নতুন ধানের ভাত। তৈরি হয় পিঠা-পায়েস। খাওয়ার পাশাপাশি কৃষকরা সবাই মিলে আনন্দও করেন। নতুন ধান তোলার এ আনন্দের নামই নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ উৎসব হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই।
এ ছাড়া হেমন্ত ঋতু শীতের পূর্বাভাস হলেও আমাদের কৃষকের কাছে এ ঋতুর বেশি গুরুত্ব ফসল ঘরে তোলার মৌসুম হিসাবে। সে জন্য অগ্রহায়ণ ধান কাটার পুরোপুরি মৌসুম হলেও কার্তিকের শুরু থেকেই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার দৃশ্য চোখে পড়ে। অন্যদিকে কার্তিক কৃষকের কাছে মঙ্গার মাস হিসাবেও পরিচিত। কারণ দীর্ঘ ৪-৫ মাস অপেক্ষার পর কৃষক অগ্রহায়ণে তার গোলায় তোলেন দীর্ঘ পরিশ্রমের সোনালি ফসল। তাই কৃষকের কাছে কার্তিকের মঙ্গা দূর হয় অগ্রহায়ণের আগমনে। শুধু মঙ্গা দূর নয়, অগ্রহায়ণ মানেই কৃষকের আনন্দ। কৃষকের শস্যোৎসব। কৃষকের এ শস্যোৎসবই আমাদের কাছে নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। আসলে নবান্ন শব্দের অর্থ-নতুন অন্ন বা নতুন খাবার। অথবা বলা যায়-নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে তৈরি চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন। গ্রামবাংলায় সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কিছু এলাকায় মাঘ মাসেও নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। আবার নবান্ন নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও রয়েছে আলাদা আচার।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা আইপিএম ক্লাবের সভাপতি প্রভাষক মতিন সৈকত বলেন, এক সময় বাংলাদেশে ধান মানেই ‘আমন’কে বোঝানো হতো। এ ধানই আমাদের অতি আদি প্রজাতির। আগে সারা দেশে এ ধানই চাষ হতো। কিন্তু ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল থেকে দেশে ‘বোরো’ প্রজাতির ধানের চাষ শুরু হয়। এখন দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ চাষকৃত ধানই বোরো প্রজাতির। আর বোরো ধানের ফসল ঘরে তোলা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। মূলত ফলন ভালো ও লাভ বেশি হওয়াতেই বোরো চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এ ধানের চাষে পরিচর্যা ও সার বেশি দিতে হয়। খরচও বেশি হয়। আর এ ধান বারো মাসই চাষ করা যায়।
অন্যদিকে আমন ধানের ফলন তুলনামূলক বোরোর চেয়ে কম হয়। এ জন্যই আমনের চাষ দিন দিন কমতে থাকে। তবে আমন ধান চাষে বোরোর চেয়ে পরিচর্যা ও সার কম দিতে হয়। বলা যায় আমন ধান অনেকটা কীটনাশক ছাড়াই উৎপাদন করা যায়। আর আমন ধানের চাষ পদ্ধতিও কৃষকের আদি পদ্ধতি। এ ছাড়া কৃষক আমন ধানের চাষ করেন নিজেদের চাষের ঐতিহ্য বজায় রাখতে।
তবে আমন ধানের ভাত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। এ চালের পিঠা-পায়েসও তাই স্বাদের হয়ে থাকে। সে জন্য গ্রামবাংলায় পিঠা-পায়েস মানেই আমন ধান।
যেহেতু এক সময় ধান মানেই আমন। আর আমন ধান ঘরে তোলা হয় হেমন্তে। তাই কৃষকের শস্যোৎসবটাও হেমন্তে হয়ে আসছে। বিশেষ করে অগ্রহায়ণ মাসে। যদিও এখন দেশের ৭০ শতাংশ জমিতে চাষ হয় বোরো। আর বোরো ঘরে তোলা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে। তবুও বাংলার অনেক কৃষক আজও অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব উদযাপন করেন। অবশ্য আগের মতো কৃষকের ঘরে ঘরে হেমন্তের সেই নবান্ন উৎসবের আমেজ আর চোখে পড়ে না। এর অন্যতম কারণই হলো-অধিকাংশ কৃষকই তো এখন বোরো চাষ করছেন। যার ফসল ঘরে আসে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে। তাই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তো আর হেমন্তের নবান্ন উৎসব করা যায় না। কুমিল্লার দাউদকান্দির আদমপুর ও পুটিয়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক মো. কালা মিয়া, মো. রোশন আলী, আবদুল মান্নান জানান-হেমন্ত এলেই গ্রামে একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। মাঠে মাঠে ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করেন কৃষক-কৃষাণী। গ্রামের প্রতি বাড়ির উঠানে দেখা যায় ধান সংগ্রহের দৃশ্য। উঠানের মাঝ বরাবর বাঁশের খুঁটি গেড়ে সেই খুঁটির চারপাশে ৮-১০টি গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হতো। আর এখন তো নানা ধরনের যন্ত্র আছে ধান সংগ্রহের জন্য। কিছু যন্ত্র তো বিদ্যুৎ বা ডিজেল দিয়েও চলে। আগে উঠানের এককোণে গর্ত করে ইট দিয়ে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হতো ধান সিদ্ধের চুলা। সকাল থেকে সারা রাত ধরে চলত ধান সিদ্ধ। এরপর সিদ্ধ ধান শুকাতে দেওয়া হতো উঠানে বা মাঠে। এরপর সেই সিদ্ধ ধান ঢেঁকিতে ভাঙা হতো।
নতুন ধান ঘরে তোলার পর কৃষকের হাতে টাকা জমত। সেই টাকা দিয়েই কৃষক ছেলেমেয়ের জন্য, নিজের জন্য জামাকাপড় কিনতেন। মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিকে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে আনতেন। তাদের জামাকাপড় কিনে দিতেন। তৈরি হতো নতুন ধানের পিঠা-পায়েস। রীতিমতো উৎসবই। আবার এ সবের পাশাপাশি আগে হেমন্তে বিয়ের প্রচলনও বেশি ছিল। কারণ কৃষকের হাতে তখন নতুন ধানের টাকা। তাই বিয়ের খরচটাও মিলত। সবকিছু মিলিয়ে হেমন্ত বা অগ্রহায়ণ মানেই ছিল কৃষকের উৎসবের দিন, আনন্দের দিন। যদিও বোরোর কারণে হেমন্তের সেই উৎসব আর এখন খুব বেশি চোখে পড়ে না। আবার ফলন কম হওয়ায় অনেক কৃষক তো আমনের চাষও করেন না। যারা করেন তারা কেবলই নিজের ঐতিহ্যের টানে বা মাটির টানেই করেন।
কৃষকের এ নবান্ন উৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ গান-কবিতাও লিখেছেন। নজরুল লিখেছেন-ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এলো কি ধরনীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।
‘বিন্নী পলাশ’ চালের ফিরনি
তশতরী ভরে নবীনা গিন্নি
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।
শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।
অবশ্য আগের মতো কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব খুব বেশি না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় কয়েক বছর ধরেই পহেলা অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব উদযাপন হয়ে আসছে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ এ উৎসবের আয়োজন করে। এর পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও কিছু স্থানে কয়েক বছর ধরে নবান্ন উৎসব উদযাপন হচ্ছে।
ছবি : লেখক
