লালন ফকিরের কুষ্টিয়া
জাহাঙ্গীর আলম মাসুম
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কুষ্টিয়াকে বলা হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের আখড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি এবং মীর মশাররফ হোসেন-এর বাস্তুভিটার জন্য ভ্রমণপিপাসুরা প্রতিনিয়ত ছুটে যান কুষ্টিয়ায়। আপনি চাইলে একদিন সময় নিয়েই ঘুরে আসতে পারেন কুষ্টিয়া থেকে। লালন শাহ সেতুর ওপর দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পাবেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও দীর্ঘতম রেলসেতু ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। শহরের উপকণ্ঠে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মোহিনী মিল দেখতে পারেন। আরও দেখে নিতে পারেন বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন ‘জগতি’ ও ‘রেন উইক’ বাঁধ যেটি গড়াই নদীর ওপর অবস্থিত। নৈসর্গিক পরিবেশে অবস্থিত কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি না হয় এক নজর দেখে এলেন!
লালন শাহের মাজার
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’-এমন মানবতার বাণী যিনি গানে-কবিতায় আজন্ম প্রচার করেছেন সেই মরমি কবি বাউল সম্রাট লালন শাহের মাজার অবস্থিত কুমারখালীর ছেউড়িয়ায়। মজমপুর গেট থেকে অটো রিকশায় চেপে লাহিনী বটতলায় নেমে আবার অটো রিকশায় যেতে হবে ছেউড়িয়ার আখড়ায়। ফকির লালনের জীবদ্দশায় তিনি এখানেই তার শিষ্যদের মানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তার মৃত্যুর পর তার সমাধি স্থলেই এক মিলন ক্ষেত্র (আখড়া) গড়ে ওঠে। লালনের আখড়া বাড়ির আয়তন সাড়ে ১৪ একর। সরকারি সহয়তায় যেখানে নতুন করে গড়ে উঠেছে লালন একাডেমি ভবন ও কমপ্লেক্স। মাজার কমপ্লেক্সে সাঁইজিসহ মোট ৩২টি সমাধি আছে। এর মধ্যে ১৪টি সাঁইজির মুরিদ, ১ জন প্রশিষ্য আর বাকি তার অনুসারীদের। আখড়া বাড়িতে সাঁইজির সাধু শিষ্যরা দলবদ্ধ হয়ে আগত ভক্ত-দর্শনার্থীদের লালনগীতি শুনিয়ে মুগ্ধ করেন। এখানে দোল পূর্ণিমার তিথিতে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর পহেলা কার্তিক লালনের তিরোভাব তিথি। আনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও লালন ভক্তানুরাগীদের সমাগম হয়। আখড়া মাজারের সামনেই রয়েছে সারি সারি বেশকিছু দোকান। যেখানে পাবেন একতারা, দোতারা, বাঁশি, করতাল, ঢোলসহ অসংখ্য লোকবাদ্যযন্ত্র। আরও পাবেন নানা কুটিরশিল্প সামগ্রী।
রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি
কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলায় অবস্থিত কুঠিবাড়িটি রবীন্দ্রসংস্কৃতি বিজড়িত একটি ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র। ১৮০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর শিলাইদহের জমিদারির মালিক হন। জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে প্রথমে আসেন ১৮৮৯ সালে। তিনি মাঝে মাঝেই এখানে আসতেন এবং এই কুঠিবাড়িতেই থাকতেন। তার অবস্থানকালে কুঠিবাড়িটি পরিণত হতো খ্যাতনামা বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মিলনমেলায়। যাদের মধ্যে ছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, লোকেন্দ্রনাথ পালিত প্রমুখ। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে এ কুঠিবাড়ি ও পদ্মাবোটে বসে রচিত হয় রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা’র অধিকাংশ কবিতা। রচিত হয় নাটক, উপন্যাস, পত্রাবলী এবং গীতাঞ্জলি ও গীতিমাল্যের গান। শিলাইদহে বসেই কবি ১৯১২ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন, যা তাকে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারের সম্মান এনে দেয়। শিলাইদহ ও পদ্মার প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর অনুরাগ। আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলজ বৃক্ষ ও অন্যান্য চিরসবুজ বৃক্ষের বাগান, পুষ্পোদ্যান এবং পুকুরসহ প্রায় ১১ একর মনোরম এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ কুঠিবাড়ি। গ্রামীণ পরিবেশ আর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি দেখতে পাবেন রবীন্দ্রনাথের নিজ হাতে লাগানো বকুল গাছ। কুঠিবাড়িটির ১৮টি কক্ষে সাজানো আছে বিশ্বকবির ব্যবহৃত পালকি, নৌকা, টেবিল, খাট, কিছু দুর্লভ ছবিসহ সেই সময়ের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। কুঠিবাড়ির প্রবেশ পথেই পাবেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা ও কুলফি আইসক্রিম চাইলে চেখে দেখতে পারেন। সাপ্তাহিক ছুটির জন্য রোববার সারা দিন এবং সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে কুঠিবাড়ি।
আরও যা দেখতে পারেন
কালজয়ী বাংলা উপন্যাস বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায় অবস্থিত। বাঙালি সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙ্গাল হরিনাথ প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা। কুষ্টিয়া সদর থানার অন্তর্গত ঝাউদিয়া গ্রামে অবস্থিত শাহী মসজিদ মোগল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে নির্মিত। এটি মোগল শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন। ব্রিটিশ আমলে কুষ্টিয়ার সঙ্গে কলকাতার রেল যোগাযোগ ছিল। ১৯০৯ সালে পদ্মা নদীর ওপর ভেড়ামারা-পাকশি রেলসেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯১৫ সালে শেষ হয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ব্রিজটি লম্বায় এক কিলোমিটার এবং এতে ১৮টি স্প্যান আছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম রেলসেতু। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর বোমার আঘাতে এর দুটি স্প্যান নষ্ট হয়। পরে ১৯৭৪ সালে আবার তা মেরামত করা হয়। বর্তমানে এর পাশেই লালন শাহ সেতুর অবস্থান।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস এবং ট্রেনে কুষ্টিয়া যেতে পারেন। রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে কুষ্টিয়াগামী এসি, নন-এসির বিভিন্ন কোম্পানির বাস রয়েছে। ট্রেনে যেতে চাইলে সুন্দরবন এক্সপ্রেস অথবা চিত্রা এক্সপ্রেসে যেতে পারবেন। ট্রেনে গেলে ভেড়ামারা স্টেশনে নেমে বাসযোগে মজমপুর যেতে হবে। সেখান থেকে অটো রিকশা বা অন্য বাহনে আপনার পছন্দের জায়গায় ঘুরে আসুন।