Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

শোলার শিল্পকর্ম

Icon

হাসান মাহমুদ রিপন

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালির ঐতিহ্য ও লোকজ জীবনের এক অনন্য শিল্পকর্ম শোলাশিল্প। এ শিল্প আমাদের দেশজ গুল্ম জাতীয় এক প্রকার উদ্ভিদ ব্যবহার করে করা হয়। আর অঞ্চলভেদে এ উদ্ভিদকে মালি শোলা ও ভাট শোলা বলে থাকে। পুলিশের দারোগাদের পোশাকের অনুষঙ্গ হিসেবে এক সময় শোলার হ্যাটের প্রচলন ছিল।। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এ বাংলাদেশ। আমাদের দেশে বর্ষাকালে জলাশয় ও নিচু জায়গায় গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ এ শোলার বংশবিস্তার ঘটে। তবে এখনও পর্যন্ত এ গুল্মজাত উদ্ভিদের কোথাও কোনো চাষাবাদ করা শুরু হয়নি। এটি বিভিন্ন ফসলের সঙ্গে আগাছা হিসেবে জন্মে থাকে।

ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, লোকাচার, ধর্মাচার, সামাজিক বিবর্তন, জাতিতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপট সব মিলিয়ে লোক সংস্কৃতিতে, লোকশিল্পে অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে শোলার শিল্পকর্ম। এ শোলার শিল্পকর্ম সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই বেশি ব্যবহার করে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত দেব-দেবীর প্রতীমা অলঙ্করণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানে, মন্দির বা কোনো স্মৃতিসৌধের মডেল তৈরির জন্য শোলার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মসৃণ ও পাতলা শোলার ফালি আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে তৈরি ক্যানভাসে জলরং দিয়ে নানা লোকজ গাঁথা ও ধর্মীয় কাহিনী চিত্রিত করা হয়ে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূজা-পার্বণে দেব-দেবীর প্রতিকৃতি শোলার ক্যানভাসে জলরঙে আঁকা হয়। এছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য তৈরি শোলার মুকুট বা টোপর এবং মালার ব্যবহার এক অপরূপ কারুকার্যময় বৈশিষ্ট্য বহন করে আসছে।

এ শিল্প জেলে সম্প্রদায়দেরও ব্যবহার করতে দেখা যায়, মাছ শিকারের বড়শির ফাতনা তৈরিতে, মাছ ধরার জাল ও গৃহসজ্জার জিনিসপত্র তৈরি করার জন্য শোলার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শোলার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী গ্রামাঞ্চলের মেলায় যেমন- চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, পৌষ মেলা, লক্ষ্মীপূজার মেলা, কালী পূজার মেলা এবং বৈশাখী মেলায় সমাদৃত। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কাছে এসব দ্রব্য সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শোলার শিল্পকর্ম তৈরি হয়। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, নওগাঁ, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম ও বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে এক সময় শোলার কাজের জন্য খ্যাত ছিল। এ পেশায় নিয়োজিত কারুশিল্পীরা মালাকার বা শোলারী নামে পরিচিত।

কথা হল ঝিনাইদহের শোলাশিল্পী গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি ৪৩ বছর ধরে এ শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত। শিশুকাল থেকে খেলার ছলে প্রথমে ককশিট দিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করতেন। প্রথম কর্মজীবনে মনোনিবেশ করেন পাকিস্তান আমলে কুষ্টিয়ার জগদীশ সুগার মিলের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে। এরপর যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দিলে তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বীর লোক হওয়ায় সেখান থেকে তার চাকরি চলে যায়। পরে ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আইডিয়াল কলেজের পিওন পদে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি প্রতিটি কর্মস্থলেই শোলা শিল্পকর্মকে তার অবসর দিন যাপনের একটি মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। ফলে তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কলেজের বিভিন্ন আসবাবপত্রের সঙ্গে আসা ফোম, শোলা বা ককশিট ব্যবহার করে শিল্পকর্ম তৈরি করতে থাকেন। এমনি করে চলতে থাকলে ওই কলেজের শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম ও এক ছাত্রীর নজরে পড়ে যায় গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর ককশিটের তৈরি অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। এক পর্যায় ওই কলেজ ছাত্রীর অনুপ্রেরণায় তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে বিসিকের বৈশাখী মেলায় তার হাতে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্মের মধ্যে শ’তিনেক পণ্য নিয়ে অংশ নেয়। সাত দিনের মেলার প্রথম দিনেই তার সব শিল্পকর্ম বিক্রি হয়ে যায়। শোলাশিল্পের প্রতি ক্রেতাদের বিপুল আগ্রহ দেখে কলেজের সবাই তাকে এ শিল্প নিয়ে কাজ করার জন্য উৎসাহ দেয়। ১৯৮৪ সালের দিকে তিনি কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে যোগদান করেন। এখানে যোগদানের পর তিনি কাজের ফাঁকে শোলাশিল্প নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করেন। এতে ওই প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা তাকে সহযোগিতা করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মেলায় তার শোলা শিল্পকর্মে অংশ নিয়ে বিভিন্ন পুরস্কারও পেতে থাকেন। ফলে দিন দিন শোলাশিল্প নিয়ে তার কাজের পরিধিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে অবসর নেয়ার পর শিল্পকর্মের প্রতি আরও বেশি মনোনিবেশ করেন। তার নিপুণ হাতে তৈরি অসাধারণ বিভিন্ন শিল্পকর্মের মধ্যে কুমির, পালকি, গরুর গাড়ি, তাজমহল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, ঘোড়ার গাড়ি, পাখা, মাছ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি শিল্পকর্ম আকার ও কারুকাজের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী জানান, শোলা শিল্পকর্ম দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িতদের পণ্য বিক্রির বাজার তৈরি করে দিলে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটবে।

কথা হল আরও কয়েকজন শোলাশিল্পীর সঙ্গে। নিখিল মালাকার, পিতা শংকর কুমার মালাকার। তিনি শোলার কাজের মূল কারিগর, মাগুরা জেলার শালিকা উপজেলার শতপাড়া গ্রামে তাদের বাড়ি। ৪ ছেলে ২ মেয়ের মাঝে নিখিল মালাকার বড়। তার রয়েছে ২ ছেলে। বংশগতভাবে তিনি এ পেশায় জড়িত। তারা দুই ভাই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা পড়ালেখা করছে। বিষ্ণুপদ মালাকার, পিতা অমল মালাকার। বিষ্ণুরা তিন ভাই দুই বোন, একই এলাকায় বাড়ি। তারা এ শোলা শিল্পকর্মের পণ্য সামগ্রী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মেলায় অংশ নেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ঢাকার বিসিক মেলা, বৈশাখী মেলা, সোনারগাঁয়ে লোকজ কারুশিল্প মেলা। শোলাশিল্পী নয়ন মালাকার, তপন মালাকার, বিশ্বনাথ মালাকার নওগাঁ জেলার আত্রাইয়ে ভবানীপুরে তাদের বাড়ি। তারা বলেন, আমরা জন্মের পর দেখেছি আমাদের দাদা-দাদিরা এ পেশায় কাজ করে আসছেন। বর্তমানে আমরাও এ শিল্পকে পেশা হিসেবে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। শিল্পীরা আরও বলেন, শোলা মূলত ধানের জমিতে বেশি হয়। আগে আমরা বিভিন্ন এলাকার ধানের জমি থেকে শোলা সংগ্রহ করতাম। কিন্তু প্রায় ১৪ বছর ধরে এ শোলা ক্রয় করে আনতে হচ্ছে। শোলা দিনে এনে শুকানোর পর খুব সামান্য পরিমাণ জলীয় পদার্থ ধারণ করে। ফলে ওজনে খুব হাল্কা হয়ে যায়। শুধু একটি ধারালো ছুরি ও কাঁচির সাহায্যে কারুশিল্পীরা বিস্ময়করভাবে তাদের দক্ষতা ও নৈপুণ্যের মাধ্যমে এই শোলা দিয়ে সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত ঝালর, চমৎকার ফুল, নানা ধরনের খেলনা, মুখোশ, সাজসজ্জা ও অলঙ্কারসহ বাংলার চিরায়িত সব নির্দশন তৈরি করেন। শোলার সব শিল্পকর্ম তৈরির জন্য প্রয়োজন তেঁতুলের বিচির তৈরি আঠা, বাঁশ, পাট, সুতা, কাগজ ও বিভিন্ন রং। শিল্পীরা জানান, শোলা শিল্পকর্ম সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই বেশি ব্যবহার করে থাকে।

লোকজ কারুশিল্পীরা জানান, আমাদের গ্রামীণ বিভিন্ন শিল্পকে ধরে রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগে এখনও কারুশিল্পের বাজার তৈরি হয়নি। ফলে দেশের একমাত্র বেসরকারি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান আড়ং গ্রামের বিভিন্ন শিল্পকর্ম নিয়ে বাজার তৈরি করলেও শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্মের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। আর তাই এসব শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা তাদের পরিবারের অন্যদের এ শিল্পের সঙ্গে নতুন করে জড়াতে চাচ্ছেন না। এসব কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের দেশীয় শোলাশিল্পসহ দুর্লভ বিভিন্ন শিল্পকর্ম।

ছবি : মো. শফিকুর রহমান

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম