মসলিনের সুদিন ফেরানোর উদ্যোগ
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মো. আবদুস সালিম
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘মসুল’ থেকে মসলিন। মসুল ইরাকের একটি বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র। সেখানে তৈরি হতো অতি সূক্ষ্ম বা উন্নতমানের কাপড়। নাম ছিল মসুল। সূক্ষ্ম ও মসুল, এ দুয়ের সংমিশ্রণে এ কাপড়ের নাম হয় মসলিন। সূক্ষ্মতা, মসৃণতা, বুননশৈলী আর নকশায় মসলিন ছিল অনন্য। হিন্দি ‘ঝিনা’ শব্দ থেকে এসেছে ‘ঝুনা’ শব্দটি। এর মানে ‘সূক্ষ্ম’। অর্থাৎ সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হতো ঝুনা মসলিন। হালকা, পাতলা জালের মতো দেখতে এ জাতীয় মসলিন। লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো প্রতিটি ঝুনা মসলিন। ওজন হতো ২০ তোলা। সাধারণত মোঘল রাজদরবারে পাঠানো হতো উন্নত ধরনের মসলিন। সেখানে গরমের সময় মসলিনের তৈরি পোশাক গায়ে দিতেন দরবারের বা হেরেমের নারীরা। এ মসলিনের নাম ছিল ‘মলবুস খাস’। এর চেয়েও উন্নতমানের মসলিন তৈরি হয়েছিল আঠারো শতকের শেষভাগে। নাম ‘মলমল খাস’। আর মসলিন কাপড় তৈরি হতো খাসসা, শবনম ইত্যাদি নামেও। ‘খাসসা’ একটি ফার্সি শব্দ। ১৭ শতকে সোনারগাঁ খাসসা মসলিন তৈরিতে বিখ্যাত ছিল। এ মসলিন যেমন সূক্ষ্ম তেমনই ঘন। তবে ইংরেজরা এ জাতীয় মসলিনকে বলতো ‘কুষা’। ‘নয়নসুখ’ মসলিনের একমাত্র বাংলা নাম। এর ব্যবহারের প্রচলন ছিল সাধারণত গলাবদ্ধ রুমাল হিসেবে। মসলিন গবেষকরা জানিয়েছেন, ৭০০ কাউন্ট মিহি সুতোয় বুনোনো মসলিনের সুতা চুলের থেকেও বেশি সূক্ষ্ম ছিল। যে মসলিনটি ৭০০ কাউন্ট মিহি সুতায় বোনা তা সহজে ভরে রাখা যেত একটি ম্যাচবাক্সে। সর্বোচ্চ ১২০০ কাউন্টের সুতার মসলিনের কথাও জানা যায়।
অতীতে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত মসলিনের গুণগান। মসলিন সম্পর্কে বলা হতো, আংটির ভেতর দিয়ে একটি শাড়িকে এপার-ওপার করা যেত। বিশ্বজুড়ে ছিল মসলিনের সুনাম এবং ব্যাপক চাহিদা। সে সব এখন অতীত। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর চাপে এখানকার মসলিন কারিগররা শাড়ি তৈরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এখন আবার শোনা যাচ্ছে মসলিনের আগমনের কথা।
সাধারণ পোশাক তৈরিতে প্রচুর রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এ সব প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ সবের বর্জ্য পানি পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করছে। ক্ষতি হচ্ছে জীববৈচিত্র্যেরও। কল-কারখানার রাসায়নিক পদার্থ উন্মুক্ত জমিতে পড়ে মাটি অনুর্বর হচ্ছে। কিন্তু মসলিন তৈরিতে ব্যবহার করা হতো শিমুল তুলা, উন্নত কার্পাসসহ আরও অনেক ধরনের প্রাকৃতিক তন্তু। এ তন্তুর দাম সাধারণ তন্তুর চেয়ে বেশি। তা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মসৃণও। জানা যায়, যে কার্পাস দিয়ে উন্নত মসলিন কাপড় তৈরি করা হয় তার নাম ফুটি কার্পাস। এর আবাদ বেশি হয় ভারতে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, আমাদের দেশ থেকে ধীরে ধীরে ফুটি কার্পাস হারিয়ে যেতে থাকে ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে। এ গাছের চাষ হতে দেখা যেত আমাদের মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা পাড়ে। তবে বিখ্যাত ছিল শ্রীরামপুর, রাজনগর, কেদাপুরসহ বিভিন্ন স্থান। এক সময়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া অঞ্চলে প্রচুর কার্পাস হতো। যে কারণে ওই স্থানের নাম হয়েছে কাপাসিয়া। মসলিনের তন্তু চাষ হতো সোনারগাঁয়ে, এ ছাড়া ঢাকা, ধামরাই, কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুরেও হতো তন্তুর চাষ।
মসলিন কাপড় তৈরির সময়ে কোনো কারণে হঠাৎ তাতে ময়লা লেগে গেলে তা ধোয়া বা পরিষ্কার করা হয় লেবুর রস দিয়ে। এ প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব। এর তৈরি পোশাক নরম বা মোলায়েম করতে ছিঁটানো হতো চাল ধোয়া পানি। এটাও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। এরপর সাবধানে ইস্ত্রি করা হতো মসলিনের কাপড় বা পোশাক। যারা এ কাজে নিযুক্ত থাকত তাদের বলা হতো কুণ্ডকার। ২০ পেরোলে তাদের দিয়ে মসলিন কাপড় বুনতে দেয়া হতো। এ কাপড় তৈরিতে প্রয়োজন হতো কোমল হাত। মসলিনে সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য ব্যবহার করা হতো তরুণী মেয়েদের। কারণ তাদের সৃষ্টিশক্তি ও কোমল হাতের ছোঁয়ায় যে সূক্ষ্মতা অনুভূত হতো, তা মসলিন তৈরির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি ছিল। কেননা এ ধরনের পোশাক তৈরির কাজ ছিল জটিল, কঠিন ও সময়সাধ্য। অসামান্য নৈপুণ্য আর পরম ধৈর্য না থাকলে মসলিন তৈরি বা উৎপাদন করা যেত না।
মসলিন কাপড় পরিবেশবান্ধব বলে ভারতের জয়পুরে প্রচুর ফুটি কার্পাসের চাষ হয়। এর বীজ আমাদের দেশে আনা হচ্ছে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে। তবে অতীতে একশ্রেণীর ফুটি কার্পাস চাষ হতো এই উপমহাদেশে। এখন তা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তপ্রায় কার্পাসের সঙ্গে এখনকার কার্পাসের কতটুকু মিল বা অমিল রয়েছে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন গবেষকরা। আসল ফুটি কার্পাস গাছ বছরে দু’বার ফল দেয়। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক স্থানের কার্পাস গাছ বছরে ফল দেয় একবার। ফুটি কার্পাস হয় সাধারণত জুন-জুলাইয়ে। এর ফল সংগ্রহ করা হয় ডিসেম্বরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভালো মানের কার্পাস সাধারণ কার্পাসের তুলনায় বেশি পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে দেশে এ ধরনের কার্পাস চাষের চিন্তা-ভাবনা চলছে। অনেক স্থানে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এখন তুলা থেকেও মসলিন তৈরি করা যাবে। এ জন্য দেশে তুলার আবাদ বাড়ানোর কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, শিমুল তুলা উন্নত মানের ও পরিবেশবান্ধব। এ তুলা দিয়ে মসলিন কাপড় তৈরি করতে সাধারণ তুলার তুলনায় রাসায়নিক পদার্থ কম লাগে। যে কারণে শিমুল তুলার চাহিদা বেশি।
সম্প্রতি মসলিন তৈরি করছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ডেমরার তাঁতিরা। তাদের তৈরি করা প্রায় সব পোশাকই শাড়ি। এ সব কাপড়ের নাম দেয়া হয়েছে ‘নতুন যুগের মসলিন’। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, ৪০০ এমনকি ৫০০ কাউন্ট সুতার মসলিন কাপড় তৈরিরও সম্ভাবনা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁতিদের আরও অভিজ্ঞ হতে হবে। তারা আরও জানান, আমাদের দেশে মসলিনের যুগ ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।
সুতা যত বেশি সূক্ষ্ম হবে, কাপড়ের গুণগত মান ততো বাড়বে। মসলিনকে বলা হয় জগৎবিখ্যাত বস্ত্র বা পণ্য। শত শত বছর আগে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতির কথা ভাবতেই পারতো না মানুষ। ওই সময়ের অতি সূক্ষ, দামি ও পরিবেশবান্ধব কাপড় মসলিন। খুশির খবর হল, মসলিনের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। মসলিনকে ফিরে পেতে তাঁত বোর্ড এক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এটি মূলত একটি বিনিয়োগ বা গবেষণা প্রকল্প। এতে মসলিনের প্রযুক্তি উদ্ধার করা হবে। পুরো প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)