|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ বছর সারা বিশ্ব থেকে বায়তুল্লাহ আগত হাজির সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। আলহামদুলিল্লা। হজ কার্যক্রম সমাপন করে নিজ দেশে ফিরতে শুরু করেছেন হাজারখানেক হাজি। তাদের অভিজ্ঞতার আলোকেই আজকের লেখনী। কেউ বলছেন তেমন কোনো সমস্যায় পড়েননি, অন্যদিকে অন্যেরা প্রচুর কষ্টে জর্জরিত ছিলেন। কারও কথাই ফেলার নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কেন এ বিভেদ! হাজিরা হন আল্লাহর মেহমান। মেহমানদের সমালোচনা করা মানায় না। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হচ্ছে যারাই হজ কার্যক্রমের প্রতিটা বিষয়ে খুঁত ধরতে থাকেন, তারাই বিপদে বেশি পড়েন। তারা দেশের আরাম-আয়েশে থাকার সঙ্গে মেলাতে থাকেন। এর ব্যত্যয় হলেই অস্থির হয়ে যান, ফলস্বরূপ বিপদে-আপদে জড়িয়ে পড়েন। হজ প্রস্তুতি ছাড়াই পবিত্র ভূমিতে গমন করেন। তাই তারা মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আদব রক্ষা করার বদলে বে-আদবি করে ফেলেন।
হজে যাচ্ছেন এটাই বড় কথা। হজ এজেন্টের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করার প্রতি আগ্রহ থাকে না। আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে জীবনের পথে এগোলে বিপদ থেকে বাঁচা যায়। হজ এজেন্টদের অনেকেই হজ নিয়ে অবৈধ ব্যবসার ফাঁদ পেতে মুনাফা অর্জন করে। এদের মধ্যে মুফতি আলেমও রয়েছেন। এরা হাজিদের উন্নতমানের সেবা দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যান। আর এসব হাজিই হজে গিয়ে নানা রকম কষ্টের মধ্যে পতিত হন। ফেরত আসা হাজিদের কাছ থেকে শুনলাম-মিনা, আরাফা, মুজদালিফায় পানির কষ্টে ও তীব্র দাবদাহে ভুগেছেন। অপরদিকে যারা তাকওয়া অর্জনকারী অ্যাজেন্টের সঙ্গে যান, তার সুন্দর একটি গাইড লাইন পেয়ে নিরাপদে থাকেন। এমনি এক হাজির কাছ থেকে জানতে পারলাম-মিনার প্রবেশদ্বারে হজের প্রয়োজনীয় উপহারসামগ্রী নিয়ে মোয়াল্লেমের নির্ধারিত ব্যক্তিরা দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বাগত জানাতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবুর ভেতরের অবস্থা অনেক উন্নতমানের হওয়ার কারণে ইবাদত বন্দেগিতে কোনো সমস্যা হয়নি। উন্নতমানের ওয়াশরুম। তাঁবুর বাইরে প্রচুর পানিভর্তি ফ্রিজ, চায়ের ব্যবস্থা হাজিরা ইচ্ছামতো ব্যবহার করছিল। উন্নতমানের প্যাকেটে মোড়ানো তিন বেলার খাবার। এছাড়া মিনা, আরাফা, মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। আরাফার তাঁবুটিও অনেক উন্নতমানের। গরম লাগার কোনোই অবকাশ ছিল না। খাবারের ব্যাপারটিও ছিল মিনার মতো। বিকাল ৪টা থেকে প্রথমে দমকা পরে মৃদমন্দ বাতাস বইতে থাকার কারণে প্রায় সবাই তাঁবুর বাইরে গাছের তলায় সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই হাত আকাশের দিকে তুলে প্রার্থনায় মগ্ন হয়েছিল। মুজদালিফায় রাতযাপন, জামারাত, কুরবানি, আবার মিনায় রাতযাপন, তাওয়াফে জিয়ারা ইত্যাদি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি মক্কা মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ের ব্যাপারে ছিলেন সন্তুষ্ট। এবার আসল কথায় আসা যাক।
১। হজের নিয়তের সঙ্গে সঙ্গে পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে হবে। এজেন্ট নির্বাচনের ব্যাপারে ইস্তিখারা করা দরকার। কারণ হজ এজেন্টের কথার সঙ্গে কাজের মিল না পেলে মনোমালিন্যের কারণে হজ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। হজ তো জীবনে একবার ফরজ। অর্থের অঙ্কের সঙ্গে সুযোগ-সুবিধার তারতম্য থাকে। এ বিষয়টি মাথায় রাখতেও হবে।
২। হজ কার্যক্রমের নেতিবাচক দিকটি নিয়ে খুবই আলোচিত হয়। এতে নতুনরা ভীত হন। জীবনের ফরজ কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যারা বিদেশ ভ্রমণ করছেন বিভিন্ন কার্য উপলক্ষ্যে তাদের কি কোনোই কষ্ট হয় না? মৃত্যুর সংবাদ আসে না? শুধুই কি আরাম! আরাম!! সূরা আল ইমরানের ৯৭নং আয়াতের বঙ্গানুবাদ বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি ও সামর্থ্য যে রাখে, সে যেন হজ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করবে সে কুফরির আচরণ করবে, তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন।
৩। হজ সফরের আচরণবিধি না জানার কারণে বিপাকে পড়েন প্রচুর হাজি। হজের ফরজ ওয়াজিব, সুন্নত সম্পর্কে জ্ঞান নেওয়ার তোয়াক্কা করেন না। বয়স ও শারীরিক অবস্থার ওপর অনেক ছাড় থাকে। দুপুরের কড়া রোদে বের হওয়া বারণ অতি প্রয়োজন ছাড়া। অজ্ঞ এবং আবেগপ্রবণ ব্যক্তিরা তাই অতি সহজেই মৃত্যু মুখে পতিত হন। রাসূল (সা.) এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার দুই ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে পা হেঁচড়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তির কী হয়েছে? লোকেরা বলল, সে পদব্রজে আল্লাহর ঘর (কাবা) জিয়ারত করতে যাওয়ার মানত করেছে। তিনি বললেন, এ ব্যক্তিকে শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করা থেকে মহান আল্লাহপাক পবিত্র। তাকে বাহনে চড়ে যেতে বলো। [বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ]
৪। সফর কষ্টসাধ্য বলেই মহান রাব্বুল আলামিন রোজা না রাখা, নামাজ সংক্ষিপ্ত এছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ওপর অনেক ছাড় দিয়েছেন।
৫। পাশ্চাত্যে বড়দিনের সময় বিভিন্ন দ্রব্যের অনেক ছাড়ের ব্যবস্থা থাকে, যাতে বড়দিনের উৎসবটি বিভিন্ন শ্রেণির জনগণ উপভোগ করতে পারে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে সৌদি আরবের কথা বলতে হচ্ছে হজ উমরা পালনকারীদের কাছ থেকে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলেন। আবাসন, খাদ্যসহ ইত্যাদিতে। আগে রমজানের পর উমরা ভিসা বন্ধ থাকত। হাজিরা জিলকদ মাস থেকে হজের জন্য জমায়েত হতো এবং বেশ আরামে তাওয়াফ করতে পারত। বর্তমানে তা না থাকায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে হাজিদের জিলকদ মাসে তাওয়াফ করতে হয়, উমরাকারীদের সঙ্গে মিনা, আরাফার তাঁবুর স্বল্পতা, পানির স্বল্পতা, যানবাহনের স্বল্পতা রোধ করে অন্যান্য সুবিধার দিকে বিশেষ নজর দিলে হাজিদের অপমৃত্যুর সংখ্যা কমবে। আমাদের দেশে রোজা, ঈদের সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হজের সময় বিমান ভাড়া বৃদ্ধি দেখলে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। অথচ ভারতের হাজিরা সরকারের তরফ থেকে কিছু ছাড় পায়। হাজার হাজির মধ্যে সাধারণ মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল। এক প্রত্যক্ষদশী জানান, তার পাশের ঠান্ডা তাঁবুতে হার্ট অ্যাটাকে এক যুবকের মৃত্যু হতে দেখেছে। আনন্দ, দেশ, এমনটি বিভিন্ন কার্যোপলক্ষ্যে ভ্রমণে মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাই বলে কি আমরা জীবনের ফরজ কাজ করার জন্য পেছনে হটে যাব! বরং সুষ্ঠু নিয়মকানুন জেনে আল্লাহ পাকের ওপর পূর্ণ ভরসা করে, তাঁর ও তাঁর হাবিবের মহান দরবারে যাওয়ার জন্য বিনীতভাবে নিবেদন করতে থাকব। আল্লাহপ্রেমিক হাজিরা পবিত্র মক্কা-মদিনার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে দেশে ফিরে সুখস্মৃতি রোমন্থনে মগ্ন রয়েছেন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
