ইসলামে কুরবানির গুরুত্ব অতিব্যাপক। কুরবানির বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন ‘এরপর সেই পুত্র (ইসমাইল) যখন তার সঙ্গে দৌড়ানোর বয়সে উপনীত হলো, তখন সে (ইবরাহিম) বলল, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখছি, আমি যেন তোমাকে জবাই করছি। অতএব, তুমি চিন্তা কর, তোমার কী অভিমত? সে বলল, হে আমার পিতা! তুমি যে আদেশ পেয়েছ, তা-ই কর, ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মাঝে দেখতে পাবে। এরপর তারা যখন উভয়েই আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে জবাই করার জন্য কপালের ওপর উপুড় করে শোয়ালো, তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করছ।’ আমি এরূপেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা (সূরা সাফ্ফাত)।
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কুরবানির অনুসরণে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ১০ জিলহজ তারিখে পশু কুরবানি করে থাকে। ইসলামে এ যে কুরবানির শিক্ষা তা কি কেবল একটি পশু কুরবানির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়ে যায়? আসলে পশু কুরবানি করাটা হচ্ছে একটা প্রতীকী মাত্র। আল্লাহতায়ালা চান মানুষ যেন তার পশুসুলভ হৃদয়কে কুরবানি করে, তার আমিত্বকে কুরবানি করে আর সেই সঙ্গে তার নিজের সব চাওয়া-পাওয়াকে আল্লাহর খাতিরে কুরবানি করে দেয়।
হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের কুরবানি এমনই ছিল। তারা ব্যক্তি স্বার্থকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছিলেন। আল্লাহর সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি কুরবানি চান আর এ কুরবানির অর্থ কেবল পশু জবাই করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ কুরবানি কারও জন্য নিজ প্রাণের কুরবানিও হতে পারে আবার কারও নিজ পশুত্বের কুরবানিও হতে পারে। আমরা যদি মনের পশুকে কুরবানি করতে পারি তাহলেই আমরা আল্লাহতায়ালার প্রিয়দের অন্তর্ভুক্ত হতে পারব। এছাড়া যত বাহ্যিকভাবে যত বড় পশুই কুরবানি দেই না কেন তা তার কাছে মূল্য রাখে না।
কুরবানি সম্পর্কে মহানবি (সা.) বিভিন্ন সময় তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কুরবানি করা আবশ্যক’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)। ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য লাভ করে অথচ কুরবানির আয়োজন করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে’ (ইবনে মাজাহ)। তাই কেউ যদি মনে করে, প্রতি বছরই তো কুরবানি দিয়ে যাচ্ছি এবার না দিলে কি হবে, এমনটি যেন কারও হৃদয়ে উদয় না হয়। কারণ কুরবানি শুধু একবারের জন্য নয় তা সারা জীবনের জন্য।
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হজরত নবি করিম (সা.) বলেছেন, গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উট ৭ জনের পক্ষ থেকে কুরবানি করা যেতে পারে (মুসলিম, আবু দাউদ)। কুরবানির জন্য উট, গরু, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা থেকে যে কোনো পশু জবাই করা যেতে পারে। উট ও গরু সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে এবং ভেড়া ছাগল প্রভৃতি এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে দিতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো কুরবানির পশুর বয়স নিয়ে। উট ৩ বছরের, গরু ২ বছরের, ভেড়া ছাগল প্রভৃতি এক বছর বয়সের হতে হবে।
দুম্বা যদি মোটা তাজা হয় তাহলে ৬ মাসের বয়সেরটিতেও কুরবানি বৈধ হবে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা একাই কুরবানি দিতে পারেন। যদি এমনও হয় যে, ভাগে কুরবানি দেওয়ার নিয়ত ঠিকই রয়েছে কিন্তু তিনি কারও সঙ্গে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলেন না আর একা একটি গরু কেনারও তার সামর্থ্য নেই সে ক্ষেত্রে তিনি একটি ছাগল কিনে হলেও কুরবানি দেবেন। কারণ আল্লাহ বান্দার হৃদয় দেখে থাকেন। কুরবানির আমল থেকে যেন কেউ বাদ না পড়েন এর দিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে।
হজরত আলী (রা.) বলেন, তিনি (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন কুরবানির পশুর চোখ, কান ভালোভাবে দেখে নেই। যে পশুর কানের শেষ ভাগ কাটা গিয়েছে অথবা যার কান গোলাকার ছিদ্র করা হয়েছে বা যার কান পেছনের দিক থেকে ফেরে গিয়েছে তা দিয়ে আমরা যেন কুরবানি না করি (তিরমিজি, আবু দাউদ, নিসাই)। হজরত আলী (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) শিং ভাঙা ও কান কাটা পশু দিয়ে আমাদের কুরবানি করতে নিষেধ করেছেন (ইবনে মাজাহ)। তাই এ বিষয়টির ওপর খুব গুরুত্ব দিতে হবে যে পশুটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি দেব তা যেন নিখুঁত হয়। কোনোভাবেই কুরবানির পশু দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত, ল্যাংড়া, কান কাটা, শিং ভাঙা এবং অন্ধ পশু কুরবানি করা বৈধ নয়।
হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এক ঈদে ধূসর রঙের শিংওয়ালা ২টি দুম্বা কুরবানি করলেন। তিনি সেগুলোকে নিজ হাতে জবাই করলেন এবং জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবর’ বললেন (মুত্তাফাকুন আলাইহি)। এছাড়া কুরবানির পশু খুব ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উচিত, ভোঁতা অস্ত্র দ্বারা জবাই করে পশুকে কষ্ট দেওয়া ঠিক নয়। তাই যারা কুরবানির পশু জবাই করবেন তারা অবশ্যই মনে রাখবেন জবাই করার অস্ত্র যেন খুব ধারালো হয়। ১০ জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে কুরবানি করা আরম্ভ হয় আর তা ১২ জিলহজ সূর্য ডুবার আগ পর্যন্ত দেওয়া যায়।
হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, একদিন রাসূল করিম (সা.)-এর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ কুরবানি কী? হুজুর (সা.) উত্তর দিলেন, তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। তারা আবার জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের কি পুণ্য আছে, হে আল্লাহর রাসূল? হুজুর (সা.) বললেন, কুরবানির পশুর প্রত্যেক লোমের জন্য একটি করে পুণ্য আছে। তারা আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! পশমওয়ালা পশুর পরিবর্তে কী হবে? অর্থাৎ এদের পশম তো অনেক বেশি। হুজুর (সা.) বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একটি পুণ্য রয়েছে (ইবনে মাজাহ)।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে কেবল তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই কুরবানি করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com