জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অকাতরে বিদ্যা বিলিয়েছেন

শরীফ উদ্দিন পেশোয়ার
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
খুব বেশি মনে পড়ছে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। মনে পড়ছে কয়েকটি কারণে। ভাষা, শিক্ষা ও ইসলামের ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লিখিত সব ভাষা শিক্ষা এবং ধর্মচর্চাকে ইবাদত মনে করতেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখে গেছেন।
আজ যেন আমরা তার অবদানকে ভুলে গেছি। এমনকি স্বীকার করতেও সময় পাচ্ছি না। হয়তো শিক্ষিতদের কাছে তার নামটা স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি ১৭টি ভাষা জানতেন। কেউ বলেন, তিনি ২০টি ভাষা জানতেন। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মূল পথিকৃত ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই আলিগড় ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব রেখেছিলেন তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার প্রতিবাদ করে এক প্রবন্ধ লেখেন দৈনিক আজাদে।
১৯১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মিলন’-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তায়, ভয়-ভালোবাসায়, চিন্তা ও কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।
পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করে দেখ, মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া কোনো জাতি কি কখনও বড় হতে পেরেছে? আরব পারস্য জয় করেছিল, কিন্তু পারস্য আরবের ভাষা নেয়নি। শুধু নিয়েছিল তার ধর্মভাব আর কতকগুলো শব্দ। সেদিন অতি কাছে যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করবে। বিদেশি ভাষার সাহায্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার মতো সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকতে পারে না।
এখন আমাদের শিক্ষিত সমাজের রুচি সাধু ভাষার দিকে। এখন এ ভাষাই চলবে। এ ভাষায়ই লেখাপড়া করতে হবে। এতেই আমাদের ভাবী বাংলার মুসলমান সাহিত্য রচনা করতে হবে। এটাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভাঙালি জাতির ভাষা হবে।
[মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সভাপতির ভাষণ। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনী, দ্বিতীয় অধিবেশন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। ১৩২৫]
তার গবেষণার ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নির্মাতা হিন্দুও নয় মুসলমানও নয়- বৌদ্ধতান্ত্রিক সম্প্রদায়। অবশ্য রূপে-রসে একে সজিব করেছেন মুসলিম আমির উমরাহরা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ই প্রমাণ করেছেন সংস্কৃত থেকে নয়, বাংলাভাষার উদ্ভব হয়েছে ‘গৌড়ী প্রাকৃত’ থেকে। যেমন বাংলায় ‘তুমি ঘোড়া দেখ’ গৌড়ীতে হবে ‘তুম্হে ঘোড়াঅংদেক খহ’।
শহীদুল্লাহ্ দেখিয়েছে সংস্কৃতিতে ‘ঘোড়া’ শব্দ নেই। আছে কেবল ‘অশ্ব’। গৌড়ী প্রকৃত (পালিভাষায়) ‘ঘোটক শব্দ পাওয়া যায়’ ঘোড়া সেখান থেকেই বাংলাভাষায় এসেছে। নেপালের নেওয়াররা মহাজান বৌদ্ধ। হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেওয়ার বৌদ্ধদের কাছ থেকে ১৯১৬ সালে কতকগুলো পুঁথি সংগ্রহ করেন। ওইসব পুঁথিতে কতকগুলো বৌদ্ধ দোহা বা সঙ্গীত রয়েছে। এই সঙ্গীতগুলো এখন প্রাচীন বাংলার নিদর্শন। শহীদুল্লাহ ওই বৌদ্ধ গানের ওপর ডক্টর অব থিসিস করেন।
বাংলাভাষার প্রতি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর যে আকর্ষণ তা বুঝা যায় পাকিস্তানি আমলে যখন বাংলা অক্ষরের বদলে আরবি-ফারসি অক্ষরে বাংলা লেখার কথা হয়। তখন তিনি তার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, বাংলা অক্ষর তার নিজস্ব অক্ষর।
এ উপমহাদেশের অধিকাংশ বর্ণমালারই উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী লিপি থেকে। আর ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব হয়েছে কোনো এক বিশেষ সেমিটিক ভাষার বর্ণমালা থেকে। তাই জন্মগতভাবে একে ইসলামী ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলা যায় না। সবাই জানেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু।
কিন্তু কখন এ কথা বলেছেন হয়তো জানা নেই অনেকেরই। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এবং রাষ্ট্রভাষা একমাত্র বাংলা করার প্রসঙ্গে ’৫৩ সালে এক প্রবন্ধে এ কথা বলেছিলেন। ১৯৫২ সালের একুশের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছিল তা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহই ভঙ্গ করেন। (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : শতবর্ষপূর্তি স্মারক গ্রন্থ পৃষ্ঠা ৩৮)।
তিনি মনে করতেন, ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহতায়ালারই সৃষ্টি। মানব চিত্তে আল্লাহতায়ালাই ভাষার বীজ রোপণ করে দিয়েছেন। তিনি বাংলাভাষার গঠন, বৈশিষ্ট্য ও বিকাশের জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাভাষার সহজ ব্যাকরণ, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও ইসলামী বিশ্বকোষ। তিনি পবিত্র কোরআন শরিফের তাফসিরও করেছেন।
১৯৫১ সালে কুমিল্লায় আয়োজি সাহিত্য সম্মেলনে বলেন, পূর্ব বাংলায় বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠিত না হলে সেটা হবে বাঙালি জাতির জন্য গণহত্যার শামিল।
আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগেই তিনি বলেছেন বর্তমানে আমাদের ভাষায় ‘স’ ‘শ’ ‘ষ’ পৃথক উচ্চারণ সাধারণত হয় না। আমরা কেবল ‘শ’ উচ্চারণ করি। র-ফলা কিংবা ল-ফলা অথবা ত বর্গের সঙ্গে একত্রিত হলেই কেবল (যেমন স্তব) বাংলায় খাঁটি উচ্চারণ আসে। ট-বর্গের সঙ্গে যুক্ত হলে আমরা মূর্ধন্য ‘ষ’ উচ্চারণ করি। না হলে তালব্য ‘শ’ বাংলার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হিন্দি-উর্দুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘স’ উচ্চারণে।
বাংলাভাষা উচ্চারণে এখনও অহরহ ভুল উচ্চারণ হচ্ছে। এমনকি সংবাদ পাঠক-পাঠিকারা পর্যন্ত ভুল উচ্চারণ করেন। যদিও অতিরিক্ত সুন্দর, সুর করে পড়ায় পড়া সুন্দর হয় কিন্তু ব্যাকরণগত ভুল থেকেই যায় একমাত্র বিবিসি বাংলা তাদের বাংলা উচ্চারণ ঠিক রেখেছে।
কোনো বাড়তি অলঙ্কার যোগনেই এবং যথাযথ। বাংলা উচ্চারণে সাধারণ মিলিত করে পড়তে হয়। আরবিতে কেবল উচ্চারণে লম্বাটে করতে হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষার জন্য কত কিছু করে গেছেন। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা নবীর (সা.) সুন্নত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রায় সারা জীবন কেটেছে ভাষার উন্নতি এবং পাঠদান করে।
আশ্চর্য লাগে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এত বড় শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি হয়েও খাঁটি মুসলমান ছিলেন। সঠিক আকিদা পোষণ করতেন। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও ছিল না। ৭২ দল বা ৭৩ দলের ফেরকা দেখা যায়নি। মানুষ সাধারণ একটু উচ্চশিক্ষিত হলেই ইসলাম সমন্ধে ভুল ধারণা করে বসে।
নতুন, নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জুড়ে দেয় ধর্মে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মধ্যে এসব ছিল না। আরও ছিল না দুনিয়ার বদলে (অর্থের বদলে) দ্বীন বিক্রি করে দেয়া। আমরা বলব ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ চিরদিনের শিক্ষিতদের, শিক্ষক, সাধারণ মানুষের পথপ্রদর্শক, গোটা মুমিন মুসলমানের আদর্শ। বিদ্যা আর আগুন দান করলেই বাড়ে যা তা তিনি কাজেকর্মে দেখিয়ে গেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক