
প্রিন্ট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:২২ পিএম
কলমের কারিগর

আল ফাতাহ মামুন
প্রকাশ: ২২ জুন ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
আরও পড়ুন
দূরে থেকেও কাছে থাকা যায়। আবার কাছে থেকেও দূরের হওয়া যায়। কতই না খোশনসিব তাদের, দূরে থেকেও কাছে আছে যারা; কতই না বদনসিব তাদের, কাছে থেকেও দূরে থাকে যারা।
দূরে-কাছের এ নিগূঢ় রহস্য যিনি আমাকে শেখালেন, তিনি আমাদের ‘দূরের’ শিক্ষক, দরদী মালী মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ। মালী তো অনেকেই হয়। দরদী মালী ক’জন হতে পারে? তাও আবার ‘দূরের’ প্রতিটি ফুলের জন্য হৃদয় উজাড় করা দরদ ক’জন মালীই বা দেখাতে পারেন? আল্লাহতায়ালার দয়া হয়েছে, তাই হৃদয়ে দয়া ঢেলে দিয়েছেন তার। আর মালী তা বিতরণ করছেন, কাছের দূরের প্রতিটি ফুলের জন্য।
এসো কলম মেরামত করি, বাইতুল্লাহর মুসাফির বই দুটি পড়ার পর মনের গহীনে একটি স্বপ্নই পেখম মেলেছিল। হায়! যদি কখনও এ ‘দূরের’ মানুষটিকে দেখতে পেতাম; যিনি বসে আছেন আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়। তখনও কী জানতাম, আমিও তেমনি যত্নে, গায়েবানা দোয়ায় শরিক আছি তার দরদমাখা বাগানের চারা হয়ে। যুগান্তরের ধর্মপাতার সম্পাদক একদিন ‘কায়দায় বিসমিল্লাহ’ বইটি দিয়ে বললেন, ‘আলোচনা লিখ।’ যেন আমার হাতে দরদী মালীর একটি দরদমাখা ফুল তুলে দিয়ে বললেন, ‘ঘ্রাণ নে।’ হে পরওয়ারদেগার! কীভাবে তোমার শোকরিয়া আদায় করব। আমি কী জানতাম হৃদয়ের গোপন ইচ্ছা এভাবেই তুমি কবুল কর। কখনও তো মুখ ফুটে চাইনি। তুমি ঠিকই মনের আশা পূরণ করেছ। তাইতো তুমি সর্বজানা আল্লাহ। অন্তর্যামী প্রেমময় খোদা।
ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেছি। সম্পাদক ফোন করে জানালেন, ‘বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণে মেসবাহ হুজুরের একটি কাফেলার সঙ্গে তোকে যেতে হবে।’ হায়! আমার কানে যেন মধু ঢেলে দিলেন তিনি। আমার মনে যেন প্রেমের ঢেউ খেলে গেল। আমার হৃদয়ের সেই অনুভূতি কীভাবে বোঝাব পাঠকদের? কলমের কালি কতটুকুই আর লিখতে পারে? প্রেমের ভাষা কতটুকুই বা প্রকাশ করা যায়? যে প্রেম ভাষায় প্রকাশ করা যায়, তা কী আদৌ প্রেম হয়? হয়তো হয়। সব প্রেমিক তো এক নয়।
ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। আহা! সেদিন রাত কীভাবে কেটেছে আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানেন। আধো ঘুম, আধো জাগার মতো রাত কেটেছে। মনে হয়েছে, এক রাত নয়- হাজার রাত অপেক্ষা করছি। কিন্তু ভোর আর হয় না। এক সময় ভোর হল। আরেকটু পরই আমি দেখতে পাব আমার প্রিয় শিক্ষক, আমার ‘দূরের শায়েখ’ দরদী মালীকে।
সময় সকাল ৭টা। গুলশানের একটি মসজিদের বারান্দায় দেখা হয়ে গেল দরদী মালীর সঙ্গে। এর আগে গাড়ি থেকে নেমে যাকেই দেখেছি তাকেই জিজ্ঞেস করেছি, মেসবাহ হুজুরকে দেখেছেন? হুজুর কোথায়? যখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, হুজুরকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। মুসাফাহা করতে গিয়ে হাতে চুমু খেয়ে ফেললাম। কাজটি তার পছন্দ হয়নি। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘আহ’। আমি জানি না, তা কি ছিল কষ্টের আহ, নাকি শেখাতে চেয়েছেন- তুমি ঠিক করোনি। হায়! যদি কষ্টের ‘আহ’ হয়, তাহলে তো আমার মতো ক্ষতিগ্রস্ত আর কেউ নেই। হে আল্লাহ! আপনি হুজুরের মুখের ‘আহ’টুকু কষ্টের নয়, শিক্ষার ‘আহ’ হিসেবে কুবল করে নিন।
সে সফরে দরদী মালী আমাদের সঙ্গে যাননি। তবে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে। প্রতিটি মঞ্জিলে। সফরের সবাই তার এ ‘থাকা’ উপলব্ধি করেছে খুব কাছ থেকে। হৃদয়ের গভীর থেকে। দূরে থেকেও কাছে থাকা যায়, সেদিন হাতে-কলমে শিখিয়েছেন তিনি আমাদের।
তিন দিনের সফর শেষে ঢাকা ফেরার পালা। জোহরের পরই রওনা হলাম। যেন সন্ধ্যার পরপরই ঢাকা পৌঁছে আমরা যে যার বাসায় পৌঁছতে পারি। আমাকে তো সম্পাদক বলেই দিয়েছেন, ‘তুই অবশ্যই আমার বন্ধু মেসবাহর সঙ্গে দেখা করে আসবি। তার পরামর্শ-নসিহত নিবি। সম্ভব হলে, একান্তে কিছু সময় তার সঙ্গে কাটাবি।
ভাগ্য প্রসন্ন হলে এমনই হয়। আসমানের মালিক দয়া করলে এভাবেই করেন। তা ছাড়া সম্পাদকের দোয়াও তো ছিল এ অধমের সঙ্গে। আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে রাত তিনটা বাজল।
ঢাকায় নয় হজরতপুরে। হজরতের হজরতপুরে। সন্ধ্যায় পৌঁছার কথা। রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই। কিন্তু পৌঁছতে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে গেল। সফরের আমীর মাওলানা ফাইরোজ ভাই বললেন, রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই। গাড়িও চলছে তার নিজ গতিতে। তারপরও এত দেরি হল। এটা নিশ্চয় আদিব হুজুরকে কষ্ট দেয়ার ফল। আমরা অনেকভাবেই সফরের আদব নষ্ট করেছি। আর আদিব হুজুর কষ্ট পেয়েছেন...
হ্যাঁ সফরের আদব আমরা নষ্ট করেছি ঠিকই। বিশেষ করে আমি। কিন্তু আরশের মালিকের দয়া তো এমনই হয়। যাকে দেন উজাড় করে দেন। মাওলানা রুমির ভাষায়-
‘আয় কমিনা বখশেসাত মূলকে জাঁহা
মানচে গুয়াম চুঁ তুমিদানি নেহাঁ।
হে দয়াময়! তোমার সামান্য দয়া আমাদের জন্য সমুদ্র;
তুমি তো না বলা কথাও বোঝ, না চাইতেই দাও।’
দরিদ্র মালির দফতর থেকে বিদায় বেলা মনের ভেতর হু হু বাতাস বয়ে গেল- অক্ষরের আঁকাআঁকিতে আমি তা আঁকতে পারব না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail : alfatahmamun@gmail.com