Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন বন্ধ হোক

Icon

রাকিবুল হাসান

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন বন্ধ হোক

শিশুদের শিক্ষা ও চারিত্রিক উন্নয়নে শাসনের অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। শিশুদের কীভাবে শিক্ষা দিতে হবে, তা রাসূল (সা.) অনুপমভাবে দেখিয়ে গেছেন।

হজরত আনাস (রা.) তার কাছে দীর্ঘ দশ বছর ছিলেন। তিনি তার গায়ে হাত তোলা দূরের কথা, একটি কটু কথাও বলেননি।

শিশুদের নামাজ শেখানোর ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘সাত বছর বয়সে উপনীত হলে তোমরা তোমাদের সন্তানদের নামাজের নির্দেশ দাও এবং তাদের বয়স ১০ বছর হলে নামাজের জন্য প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৯৫)।

হাদিসের আলোকে আইনজ্ঞদের অভিমত, সাত বছর বয়স তথা শাসন বোঝার মতো বয়স হওয়ার আগে শিশুর সঙ্গে সব ধরনের কঠোর ব্যবহার পরিহার করতে হবে। শিশুর বয়স ১০ অতিক্রম করলে নামাজ ছেড়ে দেওয়ার মতো অন্যায় করলে তাকে শাসন করা যাবে।

রাসূল (সা.) শাসনের পরিমাণও বলে দিয়েছেন, ‘তুমি তিনের বেশি আঘাত করা থেকে বিরত থাকো। তুমি যদি তিনের বেশি প্রহার করো, তবে আল্লাহ তোমার কাছ থেকে হিসাব নেবেন।’ (তাজরিদু আসমায়িস-সাহাবাতি : ২/৬৯)।

আর শিক্ষার্থীর অভিভাবক অথবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো শিক্ষার্থীকে প্রহার করতে নিষেধ করা হলে উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষেও প্রহার করার অনুমতি নেই। (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ৭/৫০১)।

কিন্তু ইসলামি ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক এ শাসননীতি উপেক্ষা করছেন। ক’দিন পর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে হেফজখানা ও মক্তবের শিক্ষার্থীকে মারধরের ভিডিও। হেফজভীতি ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে।

এসব ঘটনা কেন ঘটছে? জানতে চাইলে জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা ওমর আলী বলেন, ‘কয়েকটি কারণে এসব ঘটনা ঘটছে।

এক. যারা এ ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের ইসলামি শাসনজ্ঞান নেই। তাই নিজের ইচ্ছামতো শাসনকেই সঠিক ভাবছে। দুই. তারা ছাত্রদের মনস্তত্ত্ব বোঝে না। ফলে, বেতকেই মনে করে একমাত্র সমাধান। তিন. হেফজখানায় একজন শিক্ষকের অধীনে অনেক ছাত্র থাকায় তার মস্তিষ্কে চাপ পড়ে।

টানা ২৪ ঘণ্টা কাজ করার কারণে তার মেজাজ খিটখিটে থাকে। ফলে সহ্য করার ক্ষমতা কমে যায়। সামান্য অপরাধে শুরু করেন মারধর। চার. অভিভাবকদের পক্ষ থেকে সন্তানের সম্পূর্ণ দায়ভার শিক্ষকের ওপর ছেড়ে দেওয়া।’

এর প্রতিকার হিসাবে কী করা যেতে পারে? তিনি বললেন, ‘এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাবোর্ড বেফাক। তারা নিয়মিত হিফজখানার শিক্ষকদের শিক্ষাদান পদ্ধতি শীর্ষক কর্মশালার ব্যবস্থা করতে পারে।

একটা মনিটরিং সেল করতে পারে, যেন পদ্ধতির অনৈতিক লঙ্ঘন করলে জবাবদিহিতার জায়গা থাকে। এভাবে দু-এক বছর তৎপর কর্মশালা ও জবাবদিহিতা চালালে এ দুর্বলতা নব্বই শতাংশ কমে যাবে ইনশাআল্লাহ।’

মাওলানা ওমর আলী বলেন, তবে এমন অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যারা স্নেহ-মমতা দিয়ে রাসূলের অনুকরণে শিশুদের শিক্ষাদান করে, তাদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে থাকেন। ‘শিশুদের সঙ্গে রাসূলের আচরণ’ পূর্ণমাত্রায় অনুসরণ করলে মাদ্রাসায় শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠবে- এটি আমার বিশ্বাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাওলানা আখম ইউনুসের দৃষ্টিতে হেফজখানায় শাসনের এ রূঢ় রূপটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্ষতিকর।

আজ থেকে ১০ বছর আগে এ নিয়ে কেউ মুখ খোলেনি। ওস্তাদের শাসন ও শাস্তি সব সময় প্রাচ্যের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, এর উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা যেমন ছিল, তেমনি কখনো কখনো ব্যক্তিবিশেষের স্বভাবগত কারণে তা সীমা অতিক্রমও করত। তবে, সে ক্ষেত্রে মা-বাবা তা বরদাস্ত করে নিতেন। কিন্তু বর্তমানে তেমন নেই।

ড. আখম ইউনুস বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনে শিক্ষায়তনে ছাত্রকে প্রহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইসলামি আইনে, ছাত্রকে প্রহার করা যাবে সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিওগুলোয় সহনীয় পর্যায় ভয়ংকরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।

এতে ধর্মীয় মানসিকতা লালনকারী ব্যক্তিরা তাদের সন্তানকে হেফজখানায় দিতে উৎসাহ হারাচ্ছেন। আর ধর্মবিদ্বেষীরা এটিকে ব্যবহার করছে মাদ্রাসাবিরোধী হাতিয়ার হিসাবে। দাতারাও উৎসাহ হারাচ্ছেন মাদ্রাসায় অনুদানে।’

তাই ঢাবি অধ্যাপকের পরামর্শ হলো, হেফজখানার কর্তৃপক্ষরা যেন সতর্ক থাকেন। ইসলামের কাজ করতে গিয়ে যেন ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না করেন। হেফজখানায় যারা পড়ে, তারা সবাই শিশু।

শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। শিশুদের সামর্থ্য ও শক্তিগুলোর স্বাভাবিক ও সুষম বিকাশই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিশুদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার এবং তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ করতে শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো প্রচলিত ধারার শিক্ষা পদ্ধতির কঠোর অনুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর শিক্ষাজীবনকে বিপন্ন করতে পারে।

তাই শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক, আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি, যা তাকে কৌতূহলী ও আজীবন শিক্ষানবিশ হিসাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে, যিনি হেফজখানায় পড়াচ্ছেন, তিনি কুরআনের খেদমত করছেন। তার প্রতি যেন ছাত্র এবং অভিভাবকরা বীতশ্রদ্ধ না হয়ে পড়েন।’

হেফজখানা-মক্তবে শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়ক আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন এবং প্রয়োগে কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকের দায়িত্বের কথা বলছেন বোদ্ধামহল।

তারা বলছেন, বেফাক চাইলে এ সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত চিন্তাশীল আলেমদের মাধ্যমে হেফজখানার শিক্ষকদের ট্রেনিং।

দেশের সব হেফজখানাগুলো একটি বোর্ডের আওতায় নিয়ে আসা। প্রহার-যৌনাচারের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করা এবং আশু সমাধান প্রতিবিধান করা।

এ বিষয়ে বেফাক কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা, জানতে চাইলাম সংস্থাটির মহাপরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়েরের কাছে।

তিনি জানালেন, নাকের ডগায় বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। তাই প্রচণ্ড ব্যস্ততা এখন। আলোচ্য বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, তাদের কানেও অভিযোগ এবং প্রস্তাবগুলো এসেছে।

অচিরেই তারা মুরব্বিদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও কামনা করেন, বেফাক এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করুক।

লেখক : তরুণ আলেম ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম