কওমি সনদের স্বীকৃতি অর্জন : যুগান্তরের সরব ভূমিকা
মুফতি জহির ইবনে মুসলিম
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ফটো
পৃথিবীতে যত জ্ঞান-বিজ্ঞান আছে, সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস হল মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিম। এ জ্ঞানের সূচনা হয়েছিল গারে হেরাতে প্রথম ওহি ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খলাক’-এর মাধ্যমে।
দীর্ঘ তেইশ বছরে আল্লাহতায়ালা এর পূর্ণতা দান করেছেন। ক্রমান্বয়ে এখান থেকেই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান। ভারত বর্ষে ইসলাম বা মুসলমানের আগমন ঘটে হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে।
সে থেকে এ দেশের শিক্ষা সংস্কৃতিতে ইসলামের ভাবধারা ক্রমান্বয়ে ফুটে উঠতে থাকে। মুসলিম বণিকরা বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসায়ী কাজের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপক প্রচলন ঘটিয়ে ছিলেন।
চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে হাওকালের বর্ণনায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হয় সাত’শ হিজরির শুরুর দিকে বাদশাহ কুতুবউদ্দীন আইবেকের শাসনামলে (৬০২-৬০৬ হি.)। মোগল আমলে এর ব্যাপকতা ঘটে।
ম্যাক্সমুলারের এক সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছে ইংরেজ আগমনের আগে শুধু বাংলাতেই ছিল আশি হাজার মাদ্রাসা-মক্তব। প্রকাশ থাকে যে, সে সময় পর্যন্ত মাদ্রাসার তাবৎ ব্যয়ভার বহন করত সরকার।
শিক্ষা বলতে ছিল কেবল মাদ্রাসা শিক্ষা। অন্য কোনো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। অফিস-আদালতের ভাষা ছিল ফার্সি। কবি আবুল কাশেম ফেরদৌসের শাহনামা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ পাঠ্যবই।
এ গ্রন্থ পাঠ করলে বর্তমানের বিএ পাসের মর্যাদা দেয়া হতো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৭৫৭ সালে পলাশীর ময়দানে বাংলার স্বাধীন সুলতান নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে অস্তমিত হয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য।
দেশীয় রাজন্যবর্গের অদূরদর্শিতার দরুন ইংরেজরা দখল করে নেয় এ দেশের রাজশক্তি। তারা মুছে দিতে চাইল ইসলামি সভ্যতা সংস্কৃতি। মাদ্রাসার ওয়াকফকৃত বিষয় সম্পত্তি করে দিল বাজেয়াপ্ত। শিক্ষা ব্যবস্থায় চালু করল নতুন ধারা।
এ পরিস্থিতিতে তৎকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) অনেক ভেবেচিন্তে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা রক্ষার জন্য ১৮৬৬ খ্রি. মোতাবেক ১২৮৩ হিজরিতে ভারতের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিদ্যাপিঠ ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দ। এ দারুল উলুম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে গড়ে উঠল হাজার হাজার দরসে নেজামি বা কওমি মাদ্রাসা।
বাংলাদেশের হাজার হাজার কওমি মাদ্রসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক যুগযুগ ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে বঞ্চিত। ছিল না তাদের সনদের কোনো মূল্যায়ন আর এর প্রভাব পড়েছিল ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
শিক্ষা, কর্ম ও অর্থনৈতিকভাবে ছিল তারা বৈষম্যের শিকার। সামাজিকভাবে পাচ্ছিলেন না তারা যথাযথ মূল্যায়ন। তাই এ থেকে উত্তরণ ও নিষ্কৃতির রাস্তা বের করা ছিল বড় প্রয়োজন। বিষয়টা অনেকেই উপলব্ধি করেছিলেন।
কারণ ১৫-১৬ বছর পড়ালেখা করার পরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে এর কোনো মূল্য থাকবে না, এটা আদৌ হয় না এবং পৃথিবীর কোনো দেশে এমনটি আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই।
তবে শঙ্কাও কম ছিল না, তাই জোরালোভাবে স্বীকৃতির দাবি প্রাথমিকভাবে ওঠেনি। যতটুকু জানা যায় পাকিস্তান আমলে এ ব্যাপারে সর্ব প্রথম হজরত মাওলানা আতাহার আলী (রহ.), খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দীক আহমদ (রহ.) ও মুজাহিদে আজম মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন।
পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে বেফাক প্রতিষ্ঠিত হলে বেফাক ক্রমান্বয়ে এ ব্যাপারে কাজ করতে থাকে। বেফাকের দীর্ঘদিনের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার (রহ.) ও সহকারী মহাসচিব মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.)-এর ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।
কিন্তু যেহেতু বেফাকের অনেক প্রতিকূলতা ছিল তাই মাওলানা আব্দুল জাব্বার (রহ.) এ ক্ষেত্রে তরুণদের মাধ্যমে স্বীকৃতির দাবি জোরালো করার চিন্তা করেন। ফলে নব্বই দশকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় আমাকে সভাপতি করে গড়ে ওঠে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা পরিষদ’ ও কওমি মাদ্রাসা ছাত্র পরিষদ’। এ দুই সংগঠনের ব্যানারে একঝাঁক তরুণ আলেম ও ছাত্র, জনমত তৈরি ও স্বীকৃতির দাবি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনাসভা, মতবিনিময়, সেমিনার ও পোস্টার-লিফলেট বিতরণ শুরু করে।
সে সময় এ ব্যাপারে কথা বলা ছিল খুবই কঠিন। কোনো ছাত্র-শিক্ষক যদি এ ব্যাপারে কথা বলত তাহলে তাকে করা হতো নানাভাবে তিরস্কার। এমনকি বহিষ্কারেরও ঝুঁকি ছিল। পরবর্তীতে ২০০০ সালে বাংলার আলেমকুল শিরোমণি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হক (রহ.) এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়ে পল্টন ময়দানে বিশাল সমাবেশ ও মুক্তাঙ্গনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলে, এ দাবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি হয়।
শায়খুল হাদিস (রহ.)-এর সঙ্গে হাত মেলালেন, খতিব মাওলানা. ওবায়দুল হক (রহ.), মাওলানা. মুহিউদ্দিন খান, মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.), মাওলানা ফজুলল করীম (রহ.) (পীর সাহেব চরমোনাই), মুফতি মুহাম্মাদ ওয়াক্কাস প্রমুখ আলেম-ওলামা। কিন্তু রাজনৈতিক ঘেরাটোপে ও এক শ্রেণী স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সে দাবি মুখ থুবড়ে পড়ে এবং আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ও মাওলানা রুহুল আমীনের (গওহরডাঙ্গা) মাধ্যমে কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবি আবার সামনে আসে।
তাদের দুজনের একান্ত প্রচেষ্টায় সরকার এর প্রতি মনযোগী ও আন্তরিক হয়ে শীর্ষ আলেম-ওলামার সমন্বয়ে আল্লামা আহমদ শফীকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেন। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে সে ক্ষেত্রে স্থবিরতা চলে আসে, সে এক বিস্তৃত ইতিহাস।
পরিশেষে ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় আল্লামা আহমদ শফীর সঙ্গে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা রুহুল আমীনসহ (গওহরডাঙ্গা) দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের অষ্ট মূলনীতির আলোকে কওমি সনদের স্বীকৃতি গ্রহণ করা হবে। এর ফলে ২০১৭ সালে ১১ এপ্রিল আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন। তারপর ১৩ আগস্ট ২০১৮ কওমি সনদের স্বীকৃতি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয় এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮
বহু কাঙ্ক্ষিত প্রতীক্ষিত আলোচিত কওমি সনদ স্বীকৃতি বিল মহান সংসদে পাস হয়।
কওমি সনদের স্বীকৃতি ও দৈনিক যুগান্তর : ২০০০ সালে প্রকাশ পায় ভিন্ন ধারার কাগজ দৈনিক যুগান্তর। এ কাগজ সংবাদের বৈচিত্র্যের সঙ্গে সংবাদ জগতে ভিন্নমাত্রা যোগ করে সপ্তাহে দুদিন রঙিন ‘ইসলাম ও জীবন’ পাতা প্রকাশ করে।
এ পাতার মাধ্যমে যুগান্তর সে সময় পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়। এ পাতার বিভাগীয় সম্পাদক আলেম-দরদি, কওমি অঙ্গনের আপনজন হাফেজ আহমাদ উল্লাহর হাত ধরে গড়ে ওঠে একঝাঁক আলেম লেখক। তাদের অনেকেই এখন ইসলামী অঙ্গনে বেশ সুপরিচিত।
তিনি এ পাতার মাধ্যমে লেখক তৈরির সঙ্গে সঙ্গে কওমি আলেম সমাজ ও এ দেশের মূল স্রোতধারার মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করতে সফলকাম হয়েছেন। দীর্ঘ ১৭ বছর ‘ইসলাম ও জীবন’ পাতা আলেম সমাজকে তুলে ধরার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
এ পাতার মাধ্যমে যুগান্তর প্রচার করেছে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতার কথা, বিজয় দিবস, মাতৃভাষা, জাতীয় পতাকা, দেশপ্রেম, আলেম সমাজের মর্যাদা, ইমাম-খতিবদের দায়িত্ব-সম্মান, ইসলামী শিক্ষার তাৎপর্য, কওমি সনদের মূল্যায়নের কথা।
প্রকাশিত হয়েছে বিশিষ্ট আলেম ও সুধীজনের কলাম ও সাক্ষাৎকার। তাতে প্রকাশ পেয়েছে যেমনিভাবে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি তেমনিভাবে ফুটে উঠেছে কওমি শিক্ষার মূল্যায়নের কথা, আলেম সমাজের মান-মর্যাদার ইতিবৃত্ত। এর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী ও একদল প্রাজ্ঞ আলেম যারা তাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে আওয়াজ তুলেছেন কওমি সনদের স্বীকৃতির এবং আলেম সমাজকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদার আসনে বসানোর।
যুগান্তরের কওমি সনদের পক্ষে বেশ কয়েকটি তথ্য ও বিশ্লেষণমূলক রিপোর্টও ছিল সময়োচিত। তাই কওমি সনদের ঐতিহাসিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যুগান্তরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রকাশ থাকে যে, অনেকেই কওমি সনদের স্বীকৃতির কারণে আশঙ্কা করছেন কওমি মাদ্রাসার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা নষ্টের। আইন যেভাবে পাস হয়েছে তাতে কোনো ফাঁক-ফোকর নেই।
আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে এর সিলেবাস, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, সনদ বিতরণসহ যাবতীয় কাজ কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেমরাই সম্পাদনা করবেন। কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির আলোকে এ স্বীকৃতি কার্যকর হবে।
সর্বশেষ আইনে বলা আছে এরপরও যদি এ আইনের কোনো ধারা-উপধারা কওমি মাদ্রাসার ঐতিহ্যের পরিপন্থী হয় তাহলে তা পরিত্যাজ্য হবে। এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। বলা যায় আপাতদৃষ্টিতে এ পর্যন্ত কোনো শঙ্কার কারণ নেই।
লেখক : মুহাদ্দিস, খতিব, প্রবন্ধকার, সভাপতি, বাংলাদেশ মাদ্রাসা কল্যাণ পরিষদ