Logo
Logo
×

বৈশাখ সংখ্যা

বাংলা নববর্ষ ও পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

Icon

সাইমন জাকারিয়া

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সঙ্গে বাংলা বছরের শেষ মাস তথা চৈত্র এবং শুরুর মাস তথা বৈশাখ একসূত্রে গাথা। প্রাচীন কাল থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষ চৈত্রসংক্রান্তির বিচিত্র ধরনের কৃত্যমূলক সংস্কৃতি পালন ও উদ্যাপনের ভেতর দিয়ে বাংলা নববর্ষের উৎসব করে আসছিলেন। দুই তিন যুগ আগেও আমাদের এ ঋতুভিত্তিক চাষের দেশে চৈত্র মানে ছিল অবসরের কাল। তখন গ্রামের মানুষ অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে কৃত্য ও সংস্কৃতির অদ্বৈত্য রূপে নানা ধরনের উৎসব, নৃত্য, গীত, বাদ্যে মেতে উঠতেন। এখনো সেই সংস্কৃতির ফল্গুধারার চলমান। তবে, সবটুকু আগের মতো নেই। কেননা, এ দেশে সনাতন চাষ পদ্ধতির বদলে নতুন চাষ পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে। ফলে এ দেশের কৃষকের জীবন থেকে অবসর ঘুচে গেছে, চৈত্রেও কৃষককে ব্যস্ত রাখে তার হাইব্রিড শস্যক্ষেত্র। তাই অনেক অঞ্চল থেকেই চৈত্রসংস্কৃতির জীবনাচার, নৃত্য-গীত, কৃত্য-নাট্য ও বাদ্যের অমর সাংস্কৃতিক চর্চা বিলুপ্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে জনমানুষের স্মৃতিসত্তায়। বিগত পনেরো বছরের জনসংস্কৃতি সমীক্ষণ, তথা নিবিড়ভাবে গ্রাম-পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় এ কথা না বলে উপায় নেই। তথাপি আশার কথা, এখনো বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে শতসহস প্রতিকূলতার মধ্যেও লোকায়ত সংস্কৃতি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এ ইতিবাচক বক্তব্যের সমর্থনে আজকের রচনায় শুধু দু-একটি প্রামাণ্য উপস্থাপন করতে চাই।

প্রথম উদাহরণটি পটগান নিয়ে। পটগান হলো চিত্রকলানির্ভর এক ধরনের গীতি-নাট্যমূলক পরিবেশনা। পরিবেশনাকরী অনেক ক্ষেত্রে নিজের আঁকা চিত্রকলা নিয়ে পটগান করেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্যের আঁকা পটচিত্র নিয়ে পটগান করেন। এ ধরনের শিল্পধারার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কেননা, চিত্রকরের উল্লেখ আছে ব্রহ্মকৈবর্ত পুরাণ, পতঞ্জলির রচনা, বৌদ্ধ জাতক, জৈন ধর্মগ্রন্থ কল্পসূত্র এবং খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে রচিত কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’ ও ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকে। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হলো- আনুমানিক সপ্তম শতকে বাণভট্টের রচিত হর্ষচরিতে পটগানের একটি প্রাচীন বর্ণনা আছে এভাবে,- রাজা প্রভাকরবর্ধনের শারীরিক অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে হর্ষবর্ধন শিকার থেকে ফিরে রাজধানীতে প্রবেশ করার সময় লক্ষ করলেন- দোকানের পথে বেশ কয়েকটি বালক দ্বারা পরিবৃত হয়ে একজন যমট্টিক বা যমপট ব্যবসায়ী পট দেখাচ্ছেন। লম্বা লাঠিতে ঝোলানো পট বাম হাতে ধরে ডান হাতে একটা শরকাঠি দিয়ে চিত্র দেখাচ্ছেন। ভীষণ মহিষারূঢ় প্রেতনাথ প্রধান মূর্তির সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকটি মূর্তি। যমপট্টিক গান গাইছেন-

মাতাপিতৃ সহস্রানি পুত্রদ্বার শতানি চ।

যুগে যুগে ব্যতীতানি কস্য তে কস্য বা ভবান্ ॥

অষ্টম শতকে রচিত বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকেও যম-পটের উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত পটগানের সঙ্গে বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ কিংবা বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে উল্লিখিত যমপট্টিকার পট প্রর্দশনের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্য রয়েছে। সুদীর্ঘ পটের ওপর ধর্মরাজ যমের মূর্তি এবং যমালয়ে পাপীদের নিদারুণ শাস্তিভোগের ভয়ংকর দৃশ্য এঁকে গান সহযোগে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরায় মানুষ পাপ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকত। এভাবেই পটগানের শিল্পীরা সমাজ সংস্কারক বা সমাজের শিক্ষকরূপে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই কোনো কোনো অঞ্চলে পটগান ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় এ শিল্প মাধ্যমটি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের খুব অভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। যে কারণে পটগানের ঐতিহ্যের পরিবর্তে সংগীতবিচ্ছিন্ন কিছু তথাকথিত পটচিত্র শিল্পী আবির্ভূত হয়েছেন আমাদের নাগরিক সমাজে। কিন্তু পটগানের প্রকৃত শিল্পীদের সন্ধান অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে রয়েছে।

এখানে পটগানের সক্রিয় একটি অঞ্চলের তথা তুলে ধরতে চাই। অঞ্চলটি হলো- দক্ষিণবঙ্গের নড়াইল, যশোর, খুলনা জেলা। এসব জেলার মধ্যে নড়াইল জেলার সদর উপজেলা ও কালিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে পটগানের প্রাণবন্ত অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায়। চৈত্রসংক্রান্তিতে এ অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন বাড়ির উঠানে অষ্টক গানের পাশাপাশি পটগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নড়াইলের বিভিন্ন গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষায় গিয়ে জানতে পারি, ওই অঞ্চলে পটচিত্র শিল্পীদের অনেকেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন, অনেকে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দেহ রেখেছেন, বাকি যা দু-একজন আছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন বেন্দা গ্রামের নিত্য গোপাল পাল। তার আঁকা পটচিত্র নিয়ে এ বছর চৈত্রসংক্রান্তিতে কালিয়ায় মাধব, ফুলসুর গ্রামে বাবু, গাজিরহাটে সুকুমার ও রতন, তেরোখাদায় গৌরঙ্গ, বড়দিয়ায় শ্যামল ও বেন্দা গ্রামে ধীরেন পটগান পরিবেশন করছেন। অন্যদিকে নড়াইল সদর উপজেলার বাহিরডাঙা গ্রামের পটগানের শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন সাধকশিল্পী নিখিলচন্দ্র দাস, তিনি বাহিরডাঙা গ্রামের পটগানের শিল্পীদের জন্য তাদের গানের বাণী অনুযায়ী ১৫ ফুট লম্বা একটি জড়ানো পট এঁকে দিয়েছেন, বর্তমানে তার সেই পটচিত্র নিয়ে বাহিরডাঙা গ্রামের বিনয়কৃষ্ণ বিশ্বাস ও অরুণ বিশ্বাসের দল সম্মিলিতভাবে পটগান গেয়ে চলেছেন। তাদের পটগানে যমপটের প্রাচীন ঐতিহ্যের শিক্ষামূলক ঐতিহ্যের নবরূপান্তর ঘটেছে। গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি লোককথা, লোকপুরাণ ও জনজীবনের রঙ্গরসিকতা পটগানে স্থান করে নিয়েছে। তবে তাদের কৃত পটগানের আসর থেকে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যিক সুর-বাণীর অকৃত্রিম প্রেম-প্রকৃতি ও দর্শন একটুও দূরে যেতে পারেনি, তার বদলে নিজেদের সাংস্কৃতিক সম্পদ হারানোর বেদনা যেন রাধার অন্তর্গত কান্নার সঙ্গে এশাকার করে গায়-

“কালা বাঁশরি বাজায়

দুই নয়নের জলে রাধার বুক ভেসে যায়।

তিন সখী যায় জল আনিতে

মদ্যির সখী কালো

আগের সখীর দাঁতের মাজন

ঘাট করেছে আলো॥

দেখো ঘাট করেছে আলো

দেখো ঘাট করেছে আলো॥

তিন সখী যায় জল আনিতে

ঘাট করেছে আলো॥

কালা বাঁশরি বাজায়

দুই নয়নের জলে রাধার বুক ভেসে যায়।

ছোট খাটো মিয়া রে ভাই মুখে চাপা দাড়ি

পাকা ধানে গরু দিয়ে হুক্কা টানে বাড়ি॥

দেখো হুক্কা টানে বাড়ি বসে

হুক্কা টানে বাড়ি॥

পাকা ধানে নড়ি দিয়ে হুক্কা টানে বাড়ি॥

কালা বাঁশরি বাজায়

দুই নয়নের জলে রাধার বুক ভেসে যায়।

নদের চাঁদ কামাখ্যা গিয়ে মন্ত্র শিখিল

নারীর মন্ত্রণায় পড়ে কুম্ভির হইল॥

দেখো কুম্ভির হইল

দেখো কুম্ভির হইল

নারীর মন্ত্রণায় পড়ে কুম্ভির হইল॥

কালা বাঁশরি বাজায়

দুই নয়নের জলে রাধার বুক ভেসে যায়।

এভাবে একের পর এক বিভিন্ন ঘটনা ও লোককথা-লোকপুরাণ নিয়ে পটগানের এই সুরবাণীর ঝঙ্কার শুধু বিনয়কৃষ্ণ বিশ্বাস ও অরুণ বিশ্বাসের বাহিরডাঙা গ্রামের উঠানে সীমাবদ্ধ দেখা যায় না। তার বদলে সেই সুরবাণীর ঝঙ্কার ছড়িয়ে পড়ে নড়াইল জেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে।

দুই

পটগানের পাশাপাশি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায়ই চৈত্রসংক্রান্তির কৃত্য হিসেবে অষ্টক গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এ ধরনের পরিবেশনার দুটি ভিন্ন রূপ রয়েছে- একটি আছে ভ্রাম্যমাণ অষ্টক পরিবেশনা, আর অন্যটি সুনির্দিষ্ট কোনো বাড়ির উঠানে রাত্রিব্যাপী বিভিন্ন ধরনের অষ্টক পালার পরিবেশনা। ভ্রাম্যমাণ অষ্টক পরিবেশনায় একদল শিল্পী রাধা-কৃষ্ণ ও অন্যান্য চরিত্র সেজে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে ঘুরে ঘুরে রাধাকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা বা ঘটনার অংশবিশেষ গীত-নৃত্যের আকারে পরিবেশন করে থাকেন, এ সময় তারা বাড়ির মানুষের কাছ থেকে চাল-ডালসহ টাকা-পয়সা উপহার হিসাবে গ্রহণ করেন। অন্যদিকে অষ্টক গানের পূর্ণাঙ্গ আসর আয়োজনের জন্য শিল্পীদের বা অষ্টক গানের দলকে আগে থেকেই বায়না করতে হয় বা নিমন্ত্রণ করতে হয়। বায়নাকৃত বা নিমন্ত্রিত অষ্টক গানের দল সুনির্দিষ্ট উঠানে এসে বিভিন্ন পালার চরিত্র অনুযায়ী সাজ গ্রহণের মাধ্যমে অষ্টক পরিবেশন করেন। এ ধরনের অষ্টক গান পরিবেশনার শুরুতেই থাকে সম্মিলিত বাদ্য বাদন। বাদ্যযন্ত্রীগণ জনপ্রিয় কোনো একটি দেশাত্মবোধক গানের সুরে সম্মিলিত বাদ্য বাদন করেন। সম্মিলিত সেই বাদ্য বাদন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে উঠানের এক পাশ থেকে কৃষ্ণ, রাধা ও তার অষ্ট সখীগণ দুই বাহু তুলে বাদ্যের তালে নাচতে নাচতে বাদ্যযন্ত্রীদের সামনের অভিনয় স্থানে এসে বৃত্তাকারে কয়েকবার প্রদক্ষিণ করেন। তার মধ্যে সম্মিলিত বাদ্য বাদন শেষ হয়। আর অমনি কৃষ্ণ এবং রাধাসহ সখীগণ দুই দল বিভক্ত হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান। আসে বন্দনা পর্ব। অষ্ট গানের শিল্পীদের মধ্যে শ্রী কৃষ্ণরূপী অভিনেতার মুখোমুখি রাধা ও রাধা-সখীগণ জোড় হাতে বসে বন্দনার সূচনা করেন।

‘ওরে বন্দিলাম আমি সরস্বতী

আমার অন্তরতে দাও মা শক্তি

আমি না জানি সাধন না জানি ভজন

নিজ গুণে দাও গতি

ওগো মা মা মা॥’

বন্দনার একটি অন্তরা শেষে রাধা ও রাধা-সখীগণ বসা অবস্থা থেকে জোড় হাতে দেহের ওপরের অংশ ঘোরাতে ঘোরোতে উঠে দাঁড়ান। তারপর বন্দনার দ্বিতীয় অন্তরা শুরুর আগেই তারা আবার কৃষ্ণ চরিত্রের মুখোমুখি বসে যান এবং বন্দনার নতুন অন্তরা কণ্ঠে তুলে নেন। সরস্বতী ছাড়া পিতা-মাতা, শিক্ষাগুরুর বন্দনা করা হয় অষ্টক গানের শুরুতে।

বন্দনার পর অষ্টক গানের পালা শুরু করা হয় মূলগায়েনের বর্ণনা দিয়ে, যিনি একই সঙ্গে বর্ণনাকারী-গায়েন এবং কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। অষ্টক গানের পালার মধ্যে ‘নৌকাবিলাস’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ পালার শুরুতে থাকে একটি বর্ণনাত্মক অংশ, যেমন- ‘আজ শ্রীমতি অষ্ট-সখীকে সঙ্গে করে যমুনার দিকে আসছে। কেমন করে আসছে?’ বর্ণনাকারীর এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে গান গেয়ে ওঠে অন্যান্য শিল্পীরা-

‘তারা সারি দিয়ে আসছে

কৃষ্ণ চরণ পাবার লাগি সারি দিয়ে চলেছে

যেন হেম-কমল চলেছে

প্রেম কমল চলেছে

যেন কমলেরই মালা গো

কৃষ্ণ প্রেম সূত্রে গাঁথা ॥’

এই প্রেমের আখ্যান বর্ণনা দিয়ে অষ্টক পরিবেশনার ধারার সুর পল্লবে এক সময় দক্ষিণবঙ্গের প্রায় প্রতিটি গ্রাম আনন্দে মেতে উঠত। এখন নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সংস্কৃতি বিমুখতায় তা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের আজ সে কথাও মনে রাখতে হবে। এবার সে কথাই বলছি।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গাড়াপোতা গ্রামে অষ্টক গানের প্রতিযোগিতার ওপর ক্ষেত্র সমীক্ষায় গিয়ে জানতে পারি- সেখানে রাত্রিব্যাপী ছয়টি দলের পরিবেশনায় যে অষ্টক পালাগুলো প্রত্যক্ষ করছিলাম, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পালার রচয়িতা বাংলাদেশের মাগুরা জেলার শালিখা থানার বরইচারা গ্রামের বীরেন্দ্রনাথ রায়। বাংলাদেশে ফিরে এসে একদিন আকাশ ডাঙা বৃষ্টি মাথা করে বরইচারা গ্রামে গেলাম সেই পালাকার বীরেন্দ্রনাথ রায়ের সন্ধানে। বীরেন্দ্রনাথ রায়ের সাক্ষাৎ পেলাম, তার হাতে লেখা অষ্টক গানের পাণ্ডুলিপির একটি ফটোকপিও সংগ্রহ করলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার মুখ থেকে শুনতে হলো এক করুণ ও নতুন বাস্তবতার কথা। কেননা, তার সঙ্গে এলাকাবাসী এক কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন- ‘এটা তো দাদা চৈত্রিক মাসের গ্যান, আগে চৈত্রিক মাসে তেমুন কাজ-কাম ছিল না, একুন ব্লকের চাষের জন্যি চৈত্রিকেরও কোনো অবসর নাই, সবাই ব্যস্ত মাটের কামে, তাই একুন আর অষ্টক হয় না। তা ছাড়া, এই গ্যানের জন্যি ছোট ছাওয়াল পাল লাগে, সবাই একুন ইস্কুলি পড়ে, বাপ-মা আর তাগের গ্যান গা’তি দেয় না।’

বরইচারা গ্রামের মানুষের এই ভাষ্যে উপলব্ধিতে আসে- একদিকে ঋতুভিত্তিক কৃষিকাজের পরিবর্তে নতুন পদ্ধতির কৃষি ব্যবস্থা (ইরিগেশন, যা এলাকার মানুষের কাছে ‘ব্লকের চাষ’ নামে পরিচিত) বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চর্চার ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দিয়েছে, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অতএব, এ নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট বিশ্লেষণ এবং তা থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধান অতীব প্রয়োজন, তা না হলে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের কোনো বৃহত্তর অর্থ আমাদের জাতীয় জীবনে প্রত্যক্ষ করা যাবে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম