জীবনকথা
আরব বিশ্বের সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনুন নাফিস
যেসব মুসলিম বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের অনেক মৌলিক সূত্র আবিষ্কার করেছেন, যাদের আবিষ্কারের ফলে বর্তমান বিজ্ঞান হয়েছে পরিপূর্ণ- তাদের মধ্যে অন্যতম ইবনুন নাফিস। আরব জাহানের এ কিংবদন্তি চিকিৎসাবিজ্ঞানীর জীবনকথা লিখেছেন সেলিম কামাল
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তার পুরো নাম আলা আদদিন আবু আল হাসান আলি ইবনে আবি হাজামম আল কুরায়শি আল দামেস্কি। ইবনে নাফিস তার ডাকনাম। এ নামেই তিনি বেশি পরিচিতি লাভ করেন। কেউ আবার তাকে জানেন ইবনে আল নাফিস নামে। ১২১৩ খ্রিস্টাব্দে ইবনুন নাফিস সিরিয়ার দামেস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
মানবদেহে বায়ু ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন ইবনুন নাফিস। তিনি মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি, ফুসফুসের সঠিক গঠন পদ্ধতি, শ্বাসনালি, হৃৎপিণ্ড, শরীরে শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য দিয়ে বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। রক্ত চলাচল সম্বন্ধে তৎকালীন প্রচলিত গ্যালেনের মতবাদকে ভুল প্রমাণ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৩০০ শতাব্দীতে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন তিনি। ‘আল-শামিল ফি আল-তিব’ নামের ৩০০ খণ্ডের এক বিশাল বই লিখেছিলেন। এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি বর্তমানে দামেস্কে সংরক্ষিত আছে। তার অন্যান্য বিখ্যাত বই হল- মুয়াজ আক-কানুন, আল-মুখতার ফি আল-আগদিয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞানের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত তার লেখা ‘বুগিয়াত আল তালিবিন ওয়া হুজ্জাত আল মুতাতাব্বিন’ বইটি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। চোখের চিকিৎসায় বিশেষ সহযোগী বই তার লেখা ‘আল মুহাদ্দাব ফি ই-কাহ্ল’ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
১২৩৬ সালে নাফিস মিসরে যান। সেখানে আল-নাসরি নামের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে আল-মুনসুরি হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসক এবং কায়রোর সুলতান বাইবার্সের ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত হন।
বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী ইবনুন নাফিসের মতবাদ সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত বলে গৃহীত হলেও তাকে পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান জগতে স্বীকৃতি দেননি। তার এ যুগান্তকরী আবিষ্কার ৭০০ বছরের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। মানুষ ভুলে গিয়েছিল তার অবদানের কথা। অবশেষে ১৯২৪ সালে হঠাৎ বার্লিনের একটি লাইব্রেরিতে তার লেখা পাণ্ডুলিপি সিয়ারাহ তাসরিহ আল-কুনুন পাওয়া যায় এবং বিশ্ববাসী তার আবিষ্কার সম্বন্ধে জানতে পারেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ইবনে নাফিস ছিলেন একই সঙ্গে চিকিৎসক, জীববিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, হাদিস বিশারদ এবং ফিকহবিদ। হাদিস গবেষণা বিষয়েও তিনি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে এনাটমি বিষয়ে তিনি বহু প্রাচীন ধারণার বিরোধিতা করেন এবং তার গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রমাণসহ উপস্থাপন করেন। মনোরোগ চিকিৎসা এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃত। চোখ এবং আলোক বিজ্ঞান বিষয়েও অনেক মৌলিক তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন।
কোনো ওষুধ প্রয়োগ না করে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিকিৎসা করার ব্যাপারে ইবনে নাফিস বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে এর সফল প্রয়োগ করতেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।
এসময়ই তিনি রচনা করেন আরবি সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রথম দিকের মৌলিক উপন্যাস ‘আল রিসালাহ আল কামিল ফি- সিরাতিল নবী’। তার নিজের বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মতবাদের প্রকাশ করাও এ উপন্যাস রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তিনি ১২৬৮ থেকে ১২৭৭ সালের মধ্যে এ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থটির নামের অর্থ হচ্ছে ‘নবীর সিরাত বা জীবনের ওপর কামিলের রচনা বা থিসিস। গ্রন্থটি রিসালায়ে ফাদিল বিন নাতিক নামেও পরিচিত।
ইবনে নাফিসের এ উপন্যাস প্রাথমিক কল্পবিজ্ঞান (সায়েন্স ফিকশন) বিষয়ক রচনার একটি অন্যতম উদাহরণ। এ উপন্যাসে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্যকে তার কাল্পনিক ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইবনে নাফিস তার এ রচনাটিকে বলেছেন, ইসলামকে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিগতভাবে রক্ষার চেষ্টা।
মুসলিম এ মহামনীষী ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর পরপারে পাড়ি জমান। তিনি তার বাড়ি, লাইব্রেরিসহ সব সম্পত্তি আল-মনসুরি হাসপাতালে দান করে যান।