ছাত্র-জনতার বিজয়, প্রতিশোধপরায়ণতা পরিহার করতে হবে
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবি থেকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্ট গণ-আন্দোলন অবশেষে সরকার পতনের মধ্য দিয়ে বিজয়লাভ করল। সেনাবাহিনী প্রধানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর পাওয়ামাত্র সোমবার দুপুর থেকে পথে পথে শুরু হয় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের বিজয়োল্লাস।
গেল জুনে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। তাদের বিক্ষোভ দমনে শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে যে রক্তপাত আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার ঘটিয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি অফিসে উঠিয়ে নেওয়া, নির্যাতন, জোরপূর্বক তাদের দিয়ে আন্দোলন অবসানের ঘোষণা দেওয়া, সন্ত্রাস দমনের নামে গণগ্রেফতার-সব মিলে যে স্টিমরোলার জনসাধারণের ওপর চালানো হয়েছে, তাতে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
রোববারও সারা দেশে সহিংসতায় পুলিশসহ ৯৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সোমবারও পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছিল সহিংসতার দিকেই। তবে সেনাপ্রধানসহ বিশিষ্টজনদের প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি সেদিকে আর এগোয়নি। দুপুরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সে পর্যন্ত জনসাধারণকে সহিংসতা পরিহার করে ধৈর্য ধারণের আহ্বানও জানানো হয়েছিল।
সেনাপ্রধান জাতিকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। এখন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও সব হত্যার বিচার নিশ্চিতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর দেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি সব ধরনের সংঘাত পরিহার করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানান। এমন দূরদর্শী পদক্ষেপের জন্য অবশ্যই তারা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার দাবিদার।
আমরাও মনে করি, দেশ ও দশের স্বার্থে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সবার উদ্যোগী হওয়ার বিকল্প নেই। দেশবাসীর যে এক দফা ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন দেশে সুযোগসন্ধানীরা যেন অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সবার সতর্ক থাকা উচিত। এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন, গণভবনে আক্রমণ ও লুটপাট, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে আগুন, প্রধান বিচারপতির বাসভবন ভাঙচুর এবং সারা দেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলটির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে।
জনসাধারণের প্রতি আমাদের অনুরোধ, এ রোষ যেন দেশের শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি না ঘটায়। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরাই যেন অন্যায়ের পথ না ধরি। ভুলে গেলে চলবে না, গত কদিনে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বন্দুকের নলের মুখে বুক চিতিয়ে প্রাণ দিয়েছেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, শাহজাহান, সবুজ আলীর মতো অকুতোভয় বীর যোদ্ধারা। তাদের আত্মত্যাগের মহিমা রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। জনরোষে আর যেন প্রাণ ও সম্পদহানি না ঘটে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সবাইকেই উদ্যোগী হতে হবে।
আমরা প্রত্যাশা করি, এমন একটি যোগ্য ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে, যে সরকার দ্রুততম সময়ে স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, যাতে ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ছেদ না পড়ে।