যেন এক অমরাবতী!
শুভ্রেন্দু শেখর ভট্টাচার্য
প্রকাশ: ২০ মে ২০১৮, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিলেটের বিছনাকান্দি। ছবি: সংগৃহীত
রূপ-বৈচিত্র্য, ইতিহাস-ঐতিহ্যে অনন্য; পীর-আউলিয়া, সাধু-সন্তদের পদচারণায় পবিত্র বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগে সিলেট ছিল আসামের অন্তর্ভুক্ত। বিভক্তির পর গণভোটের মাধ্যমে সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতের ভাগে চলে যায় এবং বাকি চারটি মহকুমা নিয়ে সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সিলেট নগরীতে কেউ বেড়াতে গেলে এমন কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন যা বাংলাদেশে তো নয়ই, দুনিয়ার অন্য কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এই বিরল অভিজ্ঞতার কয়েকটির দিকে আলোকপাত করছি। প্রথমেই আসে হজরত শাহজালালের (র.) মাজার। নগরীর মধ্যে মাজার শরিফের অবস্থান হওয়ায় এবং সিলেটের অদূরে শ্রীচৈতন্যের পিতৃপুরুষের ভূমি থাকায় সিলেটকে পুণ্যভূমির পবিত্রতা ও মর্যাদায় দেখা হয়। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পুণ্যার্থী মাজার জিয়ারত করতে এই পবিত্র ভূমিতে আসেন। হজরত শাহ পরানের (র.) মাজারও সিলেটে অবস্থিত। ফলে সিলেটে পদার্পণ করলেই আপনার অন্তরে এক অনাবিল শান্তির অনুভূতি আসবে। বস্তুত এ নগরব্যাপী রয়েছে অসংখ্য পীর-আউলিয়া, সাধু-সন্তের স্মৃতিচিহ্ন, মাজার ও আখড়া।
ভূবৈচিত্র্য এ মহানগরীকে সাজিয়েছে এক অভিনব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। নগরীতে কোলাহলের মধ্যেও রয়েছে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেয়ার অবকাশ। সিলেটে একদিকে যেমন আছে সমতল ভূমি, অন্যদিকে আছে টিলা, পাহাড় ও নিচু ভূমি, খাল, নদী-নালা ইত্যাদি। একসময় অসংখ্য দীঘি-পুকুর ছিল নগরবাসীর পানীয় জলের উৎস, অন্যদিকে সৌন্দর্যবর্ধক মুক্ত বায়ু সেবনের এক উন্মুক্ত আশ্রয়স্থল। কিন্তু কালক্রমে দখলদারদের কবলে পড়ে অধিকাংশ জলাশয় আজ ভরাট হয়ে সে স্থানে অত্যাধুনিক সুপার মার্কেট, প্লাজা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
নগরীর বুকচিরে প্রবাহিত হচ্ছে সুরমা নদী। এ নদী পার হওয়ার জন্য ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কিন ব্রিজ আজও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নগরীর স্থানে স্থানে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন উঁচু ভূমি বা টিলা। যেমন রাজা গৌড় গোবিন্দের প্রাসাদ ‘মনা রায়’ নামক একটি টিলার উপর অবস্থিত বলে কথিত। তারপর আছে মানিক পীরের টিলা, যুগল টিলা, নরসিংহ টিলা ইত্যাদি। এসব টিলার ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক পটভূমি থাকায় পর্যটকদের কাছে এগুলো বাড়তি আকর্ষণ। প্রকৃতি আর আধ্যাত্মিক নিদর্শন এ মহানগরীতে বহুদিন ধরে মিলেমিশে এক অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। নগরীর মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একজন আগন্তুক হঠাৎ করেই তারাপুর চা বাগানের নৈসর্গিক পরিবেশের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। মুগ্ধ হয়ে ভাববেন, নগরীর মধ্যে সারিবদ্ধ টিলায় চায়ের বাগান কী করে হয়! তারপর সামান্য এগোলেই শহরতলীতে মালনিছড়া, লাক্কাতুরা, খাদিমনগর চা বাগানের দৃষ্টিনন্দন ছোট ছোট টিলাভূমি।
শেষ করার আগে একটা কথা না বলে পারছি না। সিলেটে নতুন এলে আপনি রিকশাচালককে ‘এই রিকশাঅলা’ বলে ডাক দিলে তিনি কিন্তু আপনার দিকে ফিরেও তাকাবেন না, অধিকন্তু মাইন্ড করবেন। রিকশা ভাড়া করতে হলে রিকশাচালককে ড্রাইভার বলে ডাকতে হবে।
শুধু সিলেট মহানগরে একটু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ঘোরাফেরা করলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আধ্যাত্মিক, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গ্রামীণ কৃষ্টি-সংস্কৃতি একনজরে আপনার কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আপনার মনে হবে, এ যেন প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা মনুষ্যসৃষ্ট এক অমরাবতী!
শুভ্রেন্দু শেখর ভট্টাচার্য : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট