বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম: উচ্চশিক্ষায় নৈরাজ্য রোধে কঠোর হতে হবে

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতীকী ছবি
পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ উঠেছে দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে এখনও ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই দুই সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করেনি; মানা হচ্ছে না শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনুমোদিত আসন সংখ্যা।
এমনকি ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধানও মানা হচ্ছে না। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ‘অ্যাপেক্সবডি’ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১৮ সালের কার্যক্রমের ওপর তৈরি বার্ষিক প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন অমান্যের এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
উদ্বেগজনক হল, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কমপক্ষে ১৬ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত। এসব দুর্নীতির মধ্যে মোটা দাগে আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয় ছাড়াও রয়েছে বড় ধরনের একাডেমিক দুর্নীতি। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অলাভজনক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানরূপে চলার কথা থাকলেও কৌশলে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওজি) বা মালিক পক্ষ অনেকটা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো সেগুলো চালাচ্ছেন।
বস্তুত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মালিকপক্ষের খামখেয়ালিপনা ও ক্রীড়নকে পরিণত হওয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মালিকানা দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তে পাঠদান, কোচিং সেন্টারের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, ভাড়ায় শিক্ষক এনে জোড়াতালির ক্যাম্পাস পরিচালনা, সনদ বিক্রি, ক্যাম্পাস ও শাখা বিক্রিসহ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমনসব কীর্তিকলাপ চলছে, যা এক কথায় ভয়াবহ। উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে এরকম নৈরাজ্য চলতে থাকলে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।
দেশে পাসের হার বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। তবে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির অনুপাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এরই সুযোগ নিয়ে অনেকেই কোচিং সেন্টারের আদলে বহুতল ভবনের একটি বা দুটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্যের পসরা খুলে বসেছেন। এগুলোর মধ্যে গুটিকয় স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করে পাঠদানের সদিচ্ছা দেখিয়েছে; বাদবাকিগুলো চলছে ‘হরিশঙ্করের গোয়াল’ স্টাইলে, যা অনভিপ্রেত।
মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে হাজার-বারোশ’ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট কয়েকটি ক্লাসরুম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা অনেক ব্যাপক। নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, পাঠাগার ও গবেষণাগারসহ সমন্বিত পাঠদানের জন্য আনুষঙ্গিক সবকিছুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা প্রয়োজন। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখছি? বিপণিবিতান, বাসস্ট্যান্ড, আবাসিক এলাকা, এমনকি শিল্পকারখানার আশপাশের ভবনে গড়ে ওঠা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় না আছে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, না আছে জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিদার প্রতিষ্ঠানগুলো চটকদার বিজ্ঞাপন ও নানা কৌশলের আড়ালে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি আদায় করে যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে; তাতে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষিত। দুঃখজনক হল, এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়।
দেশের আর দশটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও যদি সেই একই চিত্র বিরাজ করে, তাহলে উচ্চশিক্ষায় নৈরাজ্য সৃষ্টিকেই উৎসাহ দেয়া হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা দূর করার ব্যাপারে সরকার দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দেবে- এটাই প্রত্যাশা।