ছবি: সংগৃহীত
মানবসভ্যতার ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তনের ধারার সঙ্গে মৃৎশিল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য হাজার হাজার বছর আগের। ধারণা করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে সর্বপ্রথম মাটির পাত্র তৈরি হয়। সবচেয়ে উন্নতমানের অলঙ্কৃত মৃৎপাত্র তৈরি হতো বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের সুসা অঞ্চলে। মিসর, মেসোপটেমিয়া ছাড়াও সিন্ধু তীরবর্তী এলাকা, চীন, পারস্য ও এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাসও সমৃদ্ধ ও বহু প্রাচীন।
দুঃখের বিষয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্প। এক সময় এই শিল্পই ছিল অনেকের বেঁচে থাকার সম্বল, রুটি-রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য দামে যেমন ছিল সস্তা, তেমনি ছিল সৌন্দর্যবর্ধক। এক সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মেলা, পূজা-পার্বণ ইত্যাদিতে গেলেই চোখে পড়ত নানারকম বাহারি হস্তশিল্পের পণ্য, যেমন- মাটির কলসি, সানকি, সরা বা ঢাকনা, ছোট-বড় তাগার, হুক্কা, বিভিন্ন রকম পুতুল, দেব-দেবীর মূর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট, ফুলদানি ইত্যাদি। আজ আর আগের মতো মেলা, পূজা-পার্বণে এসব মাটির জিনিস তেমন চোখে পড়ে না। এখন বড় বড় শহরের কিছু অভিজাত হ্যান্ডিক্রাফ্টসের শো-রুমেই কেবল এসব পণ্যের কিছুটা চোখে পড়ে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। মানুষ আজ ঝুঁকে পড়েছে এর বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পরিবেশবিধ্বংসী পণ্যের দিকে। ফলে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অনেকেই আজ বেকার এবং এই শিল্প আজ একরকম বিলুপ্তির পথে। আর আমরা পরিবেশকেও ঠেলে দিচ্ছি ধংসের মুখে।
হস্তশিল্পের পণ্য রফতানিতে ভালো সম্ভাবনা থাকলেও এ ক্ষেত্রে দ্রুত এগোতে পারছে না দেশ। গত ৫-৬ বছরে এ খাতের রফতানি আয় দ্বিগুণ হলেও এখনও আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সারা দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অনেকটা অগোছালোভাবেই। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো প্রদর্শনব্যবস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে এসব তৈরি পণ্যের অধিকাংশই পৌঁছায় না। এছাড়া পণ্যের নকশা, কারুশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য নেই কোনো প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে শন, বাঁশ-বেতের চাষ কমে যাওয়ায় কাঁচামালের সংকট প্রকট হচ্ছে।
এসব শিল্পকে বাঁচাতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। এ জন্য স্থানীয়ভাবে এই শিল্পের কাঁচামাল অর্থাৎ বাঁশ, বেত, শন ইত্যাদি চাষে সংশ্লিষ্টদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, খাশ জমি বরাদ্দ করতে হবে এবং হস্তশিল্প গবেষণা ও ডিজাইন উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে গ্রামবাংলার এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প আবারও প্রাণ ফিরে পাবে। পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার মাধ্যমে বেকারত্বের হার কমবে এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দখলের মাধ্যমে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
নাজমুল হোসেন : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক
naymulhussen@yahoo.com