Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

এই নৃশংসতার ব্যাখ্যা মনোবৈজ্ঞানিক

Icon

লাভা মাহমুদা

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এই নৃশংসতার ব্যাখ্যা মনোবৈজ্ঞানিক

তুহিন। ছবি: যুগান্তর

পাঁচ বছরের ছোট্ট তুহিনের বীভৎস ছবিটা যখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখনই আঁতকে উঠি, মাথার ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা হয়, খুব অসহায় বোধ করি। কোনো মানুষ এতটা নির্মম, নৃশংস হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারি না।

রক্তের সঙ্গে রক্তের টান স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে হওয়ার কথা, সেখানে পিতাই কিনা নির্মমতা দেখালো আত্মজের সঙ্গে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঔরসজাত সন্তানকে নৃশংসতম কায়দায় হত্যা করল বাবা।

সন্তানের জন্য পৃথিবীর নিরাপদতম আশ্রয়টির নাম পিতা। বিপদে-আপদে, আনন্দ-বেদনায় সন্তানরা পিতার বুকেই মুখ লুকায়, আশ্রয় খোঁজে। সন্তানের মুখে নির্মল হাসি দেখার আর সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা মানুষটিই তো পিতা।

সেই পিতাই কিনা ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় জবাই করল, অঙ্গ কেটে ছোট্ট দেহটি ঝুলিয়ে দিল গাছে, পেটে ঢুকিয়ে দিল দুটো ছুরি! নৃশংসতার সব মাত্রাই অতিক্রম করেছে এই বাবা। সঙ্গে ছিল ঘাতকরূপী চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোনের মতো নিষ্ঠুর স্বজনরা।

নিশ্চয়ই এই দুষ্কর্ম করার আগে এর পরিকল্পনা হয়েছিল। শিশুটিকে হত্যা করে কতটা বীভৎস রূপ দেয়া হবে তা-ও ঘাতকদের আলোচনায় ছিল। এমন ভাবনা বা পরিকল্পনার সময় ছোট্ট তুহিনের দুষ্টুমিভরা হাসিমাখা মুখখানি কি তাদের একবারও আন্দোলিত করেনি?

একবারের জন্যও মনে হয়নি এই নিরপরাধ-নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করার কোনো অধিকার তাদের নেই? বেঁচে থাকার অসীম সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল সে এ পৃথিবীতে।

আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নিজের মেয়েকে দুর্বৃত্তের হাতে তুলে দেয়া, গলাটিপে শিশুপুত্রকে হত্যা করা বা বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা, সদ্যোজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার অনেক উদাহরণ আছে। আগে হয়তো তেমনভাবে প্রকাশিত হতো না। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ঘটনাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ পায়। তবে নির্মমতা বা ভয়াবহতার মাত্রার আনুপাতিক হারটা কেমন, তা গবেষণার বিষয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে মানুষের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্যায়-অপকর্ম করে পার পাওয়া যাবে বা বিচারে কিছুই হবে না, এমন মনোভাব থেকেও মানুষ দুর্বৃত্ত হয়ে উঠছে। মানুষ শালীনতাবোধের সব সীমাই লঙ্ঘন করেছে।

অন্যায়-অবিচারকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। সামাজিক বিবর্তনের ধারায় মানুষের সুশীল হওয়ার কথা, সভ্য হওয়ার কথা। কিন্তু সমাজটা বদলে যেতে যেতে হিংস্র হয়ে উঠছে। মানুষ এখন এতটাই বদলে গেছে যে, কোনো তত্ত্বই আর কাজ করছে না। প্রচলিত মনস্তত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব দিয়ে এ বিষয়গুলোকে এখন আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।

মনে করতে পারি, গত ১০-১৫ বছর আগেও পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ ছিল না। মানুষের নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ছিল খুবই স্পষ্ট। মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল; কিন্তু মানসিকতা ছিল অনেক উপরে। এখন হঠাৎ করেই সব উবে গেছে।

হঠাৎ করে বলাটা ঠিক হল না, বেশ অনেকদিন থেকেই ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে এ সমাজ, সমাজের মানুষ। তবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনেও ভিন্নতা থাকে।

জল ও জোছনার শহর সুনামগঞ্জের দিরাই যেমন জন্ম দিয়েছে শাহ আবদুল করিমের মতো একজন কিংবদন্তির, তেমনি জন্ম দিয়েছে আবদুল বাছির নামের মানুষের মতো দেখতে এক দানবকে। তবে শাহ আবদুল করিমের মতো মানুষরা ক্ষণজন্মা, বাছিরের মতো কুলাঙ্গারদের দিয়েই সমাজে এতটা ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটছে।

অন্যায়, অবিচার, নির্মমতা, নৃশংসতা- বিষধর সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে এ সমাজকে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী, তা সুনিশ্চিত করে কেউই বলতে পারবে না। মনোবিজ্ঞানীদের ব্যাপক গবেষণায় হয়তোবা এ থেকে পরিত্রাণের উপায় মিললেও মিলতে পারে।

এ দেশ, এ সমাজ এখন আর মানুষের বাসযোগ্য নয়, শিশুদের তো নয়ই। একবিংশ শতকের বাংলাদেশ শিশুদের নিরাপদ আবাস হওয়ার যে অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম, তা হয়তো কোনোদিনও পূর্ণতা পাবে না। কারণ যে দেশ পুত্র হন্তারকের, সে দেশ শিশুদের হতে পারে না।

লাভা মাহমুদা : শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম