আবার ফিরছেন বাদ পড়া নেতারা
হেফাজতের নেতৃত্ব নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড
পদ-পদবির ভাগভাটোয়ারায় ব্যস্ত থাকলে হেফাজতকে খুঁজে পাওয়া যাবে না -ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবিদার হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফের যুক্ত হচ্ছেন বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতারা। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে এই নেতাদের ২০২১ সালের ৭ জুন সংগঠটির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
বাদ পড়া এসব আলোচিত-সমালোচিত নেতাদের ফেরাতে অনেক দূর এগিছে বর্তমান কমিটি। তাদের কী পদ দেওয়া হবে তাও চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে তাদের তালিকা আগামী মাসে প্রকাশ করা হবে বলে হেফাজতের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তবে এই পদক্ষেপ নিয়ে সংগঠনটির মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দুঃসময়ে যারা সংগঠনের হাল ধরেছেন, তাদের বাদ দিয়ে সমালোচিতদের আবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া হলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন তারা।
তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাদের আবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দিলে সংগঠন ফের হোঁচট খেতে পারে। পাশাপাশি সংগঠনটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর গঠিত ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে অজ্ঞাত কারণ দেখেয়ি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (প্রয়াত)। এরপর আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এর দেড় মাসের মাথায় কমিটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়; যেখানে বিতর্কিতরা বাদ পড়েন। তবে গত ৫ আগস্ট বর্তমান আমিরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে বাদ পড়া নেতাদের আবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাদের ফেরাতে সংগঠনের মহাসচিবকে আহ্বায়ক করে ১২ সদস্য বিশিষ্ট সাব-কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এরপর থেকে বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতারা জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মাঠে মূল্যায়িত হওয়ার আশায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এদিকে ১৬ আগস্ট রাজধানীর ফুলবাড়িয়া জামে মসজিদে কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের সভাপতিত্বে ৫ আগস্ট গঠিত সাব-কমিটির বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বিলুপ্ত কমিটির আলোচিত-সমালোচিত নেতাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফেরানোর পাশাপাশি দুঃসময়ের নেতাদের বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে বাদপড়া নেতারা বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিকে অদৃশ্য চাপে রেখেছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগামী মাসে বিলুপ্ত কমিটির সদস্যরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফিরছেন। এ কারণে দুঃসময়ের ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন নেতারা হতাশ। কারণ তাদেরকে বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এই তুঘলকি কাণ্ড নিয়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, দুঃসময়ে যারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংগঠনকে আগলে রেখেছিলেন, এখন তাদের অনেককেই সরানোর আভাস দেওয়া হয়েছে। তাহলে তাদের ত্যাগের কী মূল্যায়ন করা হলো? তাছাড়া যাদের কারণে হেফাজত সমালোচিত হয়েছে এবং সংগঠনিক কার্যক্রম প্রশ্নবৃদ্ধ হয়েছে; তাদের কোনো আবার ফেরানো হচ্ছে?
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে সংঘাতের পর প্রয়াত আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি বিলুপ্ত করেছিলেন। এরপর নতুন আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল।
দেড় মাসের মাথায় আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির পদে রেখে ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আলোচিত মাওলানা মামুনুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ যারা সহিংসতার মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের রাখা হয়নি।
ওই সময় সংগঠনটির মহাসচিব প্রয়াত নুরুল ইসলাম জিহাদি বলেন, হেফাজতের নতুন কমিটি ‘সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
কোনো চাপের কারণে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, চাপের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কেউ আমাদের চাপ দেয়নি। যদিও পরবর্তী সময়ে হেফাজতের কয়েকজন শীর্ষ নেতা কমিটি বিলুপ্তির পেছনে সরকারি চাপ ছিল বলে অভিযোগ করেন।
এদিকে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতা যারা এতদিন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে ছিলেন তারা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। এছাড়া সংগঠনটির বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস (শায়খুল হাদিস), খেলাফত আন্দোলন ও নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরও ৩-৪টি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় রয়েছেন।
এর মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিসের (শায়খুল হাদিস) নেতারা হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সবচেয়ে বেশি পদ দখল করে আছেন বলে হেফাজতের এক নেতা জানিয়েছেন।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক এই সংগঠনের বর্তমান কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ইমান-আকিদা রক্ষায় হেফাজত আন্দোলন সংগ্রাম করে মাঠে থাকলেও ইমানি জজবা তারা দেখাতে পারেনি। ২০১৩ সালে ৫ মে শাপলা চত্বরে কতজন মাদ্রাসা ছাত্র আহত-নিহত হয়েছেন, বিষয়টি হেফাজতের শীর্ষ নেতারা এখনো পর্যন্ত নির্দিষ্ট করতে পারেননি। আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পরে হেফাজতের জনপ্রিয়তা নানা কারণে হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে তারা যদি পদ-পদবির ভাগভাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে হেফাজতকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ ব্যাপারে জানতে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানকে বেশ কয়েকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে, সাব-কমিটির সদস্য ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক মুফতি জসীমুদ্দীন বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকায় সাব-কমিটির বৈঠকে উপস্থিত কমিটির সদস্যরা বিলুপ্ত কমিটির অনেক নেতার নাম পদ-পদবির বিষয়ে প্রস্তাব করেছেন। প্রস্তাবিত নাম এবং পদবি যাচাই-বাছাই করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটি যা সিদ্ধান্ত নেবে তা আপনাদের জানানো হবে।