মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা
শরীরে ক্ষত আর হৃদয়ে কষ্ট নিয়ে অতিবাহিত করছেন জীবন
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিকে রক্ত, লাশ আর ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ যেন মৃত্যুপুরী। শত শত নেতাকর্মী শরীরে গ্রেনেডের স্পিন্টার নিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি। কারও দিকে করোর তাকানের খেয়াল নেই। তবে কঠিন এ সময়েও তারা ভুলে যাননি প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কথা। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের মধ্যেও আওয়ামী লীগের নেতারা মানববর্ম তৈরি করে তাকে আগলে রাখেন। স্পিন্টারের আঘাতে নেতাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। তবে কোনো স্পিন্টার ছুঁতে পারেনি তাদের নেত্রীকে। এভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সেই ভয়াল দিনে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে ফিরলেও তার ডান কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত হন ২৪ জন। আহত হয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েকশ নেতাকর্মী। তাদের অনেকের শরীরে স্থায়ী রোগ বাসা বেঁধেছে। অনেকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। ভালো কর্মসংস্থান হয়েছে কারও। তবে শারীরিক অচলাবস্থার কারণে অনেকেই পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে নিয়মিত হতে পারেননি। শরীরে ক্ষত আর হৃদয়ে কষ্ট নিয়ে যন্ত্রণার জীবন অতিবাহিত করছেন তারা।
ঘটনার দিন মঞ্চে ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ। তিনি সেদিনের স্মৃতিচারণা করে যুগান্তরকে বলেন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং নিরাপত্তারক্ষী নজিব আহমেদ ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে নেত্রীকে আগলে ধরেন। তখন সবার নজর ছিল নেত্রীর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। এজন্য সবাই মিলে নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম তৈরি করেন। পরে সবাই ঘিরে রেখে তাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। আমার শরীরেও প্রচুর স্পিন্টার ঢোকে। আমেরিকায়ও এজন্য চিকিৎসা নিয়েছি। কিছু স্পিন্টার বের করা হয়েছে। অনেকগুলো আবার রয়ে গেছে। এগুলো বের করলে ‘মাসল ড্যামেজ’ হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এজন্য এগুলো বয়েই চলতে হচ্ছে। যার জন্য প্রতিবছর শরীরে মারত্মক যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম যুগান্তরকে বলেন, আমি গ্রেনেড হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। প্রথম বিস্ফোরণেই আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। পরবর্তী বিস্ফোরণে জ্ঞান ফিরে পাই। অসংখ্য স্পিন্টার আমার শরীরের লেগেছে। মাথা, বুক, পা-সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এগুলো এখনো আছে। আল্লাহর অসীম রহমতে বেঁচে আছি। যতদিন আছি, এগুলো নিয়েই থাকতে হবে। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো কেঁপে উঠি। কী এক মানবসৃষ্ট কেয়ামত সেদিন বিএনপি-জামায়াত তৈরি করেছিল।
সেদিনের ঘটনায় এখনো শরীরে স্পিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন। তিনি বলেন, সেদিন সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলপূর্ব সমাবেশের অস্থায়ী মঞ্চ করা হয় ট্রাকের ওপর। আমি সেই মঞ্চের পাশেই দাঁড়ানো ছিলাম। হঠাৎ গ্রেনেড বিস্ফোরণে আমিসহ সিঁড়ির গোড়ায় থাকা সবাই পড়ে যাই। আমার পেট থেকে পা পর্যন্ত স্পিন্টারে বিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক, ওষুধ কোনোটাই পাইনি। পরে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। আমার সঙ্গে থাকা বরিশালের সেন্টু ওই ক্লিনিকেই মারা যায়। আমার খাদ্যনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে নেত্রী ভারতে পাঠিয়ে আমার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তবে এখনো শরীরে অনেক স্পিন্টার রয়ে গেছে। যেগুলো মাঝেমধ্যেই যন্ত্রণার কারণ হয়। সেদিনের হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। কিন্তু মানববর্ম তৈরি করে আল্লাহর রহমতে তিনি সেদিন বেঁচে যান।
২১ আগস্টের ভয়াবহ হামলায় শরীরে ৫৬টি স্পিন্টার নিয়ে যন্ত্রণার জীবন অতিবাহিত করছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান। বর্তমানে তিনি ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘কিডনিসহ শরীরের শিরায় শিরায় স্পিন্টার রয়ে গেছে। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। এখনো যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি। তবে শান্তির জায়গা হলো আল্লাহ নেত্রীকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’
তৎকালীন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সূচনা রানী হালদার গ্রেনেড হামলার অন্যতম ভুক্তভোগী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দের পরই পেছনে তাকিয়ে দেখি লাশ আর লাশ। মারাত্মক আহত অবস্থায় আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে শমরিতা হাসপাতালে যাই। তিনি বলেন, ‘নেত্রী খেয়াল রেখেছিলেন বলেই আজও বেঁচে আছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসে দ্বিতীয় সচিব (রাজনৈতিক) পদে যোগ দিই। তবে শরীরে এখনো সেই স্পিন্টার বয়ে চলেছি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কঠিন রোগ বাসা বাঁধছে।’
বেঁচে যান শেখ হাসিনা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের উপর্যুপরি বিস্ফোরণে মৃত্যুর মুখেও তাকে ছেড়ে যাননি দলের নেতাকর্মীরা। ২০০৭ সালের ২২ নভেম্বর মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডিকে ১৬১ ধারায় শেখ হাসিনার দেওয়া জবানবন্দি, গ্রেনেড হামলার কিছুক্ষণ পর বিবিসিকে দেওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতির টেলিফোন সাক্ষাৎকার এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বর্ণনায় সেদিনের ভয়াবহতার কথা উঠে আসে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সিআইডিকে দেওয়া তার জবানবন্দিতে বলেন, বিকাল সাড়ে ৪টায় আমি সুধাসদন থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের র্যালির উদ্দেশে রওয়ানা হই। আমার গাড়িবহর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছার পর আমি মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত ট্রাকে উঠি। ট্রাকের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ গজ পূর্বদিকে। ট্রাকটি পূর্বমুখী অবস্থায় ছিল। ট্রাকের পেছনের দিকে রক্ষিত কাঠের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মুখ করে আমি কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখি। বিকাল ৫টা ২২ বা ২৩ মিনিটে আমার বক্তৃতা শেষ হয় এবং আমি ট্রাক থেকে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম। এ সময় ফটোসাংবাদিক গোর্কি (এসএম গোর্কি) আমাকে জানায়, সে ছবি নিতে পারেনি। যখন আমি তাকে ছবি নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য একটু থামি, ঠিক তখনই সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বিস্ফোরণের শব্দ হয়। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে আমরা যারা ট্রাকের ওপর ছিলাম, সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে, বসে পড়ি। এরই মধ্যে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। বিস্ফোরণ একটু থামলে কর্মীরা আমাকে বুলেটপ্রুফ জিপ গাড়িতে তোলার চেষ্টা করেন। আমি জিপের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আবারও বিম্ফোরণ শুরু হয়। আমাকে টেনে ট্রাকে রক্ষীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুনরায় মানববর্ম তৈরি করে নেতাকর্মীরা আমাকে রক্ষা করার জন্য তৎপর হন। এরপর একপর্যায়ে আমাকে বুলেটপ্রুফ জিপে তোলা হয়। সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার সময় আমি সুধাসদনে পৌঁছাই।