রাজধানীর মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড
বছর যায়, ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন আর হয় না
১৮ বছরেও দোকান ফিরে পাননি গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেটে ক্ষতিগ্রস্তরা

শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

করোনার ধাক্কায় কোমর ভেঙে গিয়েছিল অনেক ব্যবসায়ীর। চেষ্টা ছিল সোজা হয়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু এরই মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অঙ্গার সাজানো স্বপ্ন। ব্যবসা হারিয়ে পথে বসার জোগাড়। কেউ কেউ ভবঘুরে জীবন বেছে নিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনের মুখোমুখি অনেকে। এমন হাজারো জীবনের অস্ফুট দুঃখগাথা কান পাথলেই শোনা যায় নিউমার্কেটের পথে পথে। যেখানে কদিন আগেও ক্রেতার আনাগোনায় সরগরম ছিল তাদের দোকানগুলো, যা এখন এক হাহাকারের রাজ্য।
এমন অবস্থায় ক্ষোভ বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের। সব হারানো অধিকাংশ ব্যবসায়ীর পুনর্বাসন হয়নি যুগ যুগ ধরেও। ফলে নিঃস্ব হচ্ছে বহু ব্যবসায়ীর পরিবার। কারও দিশেহারা দশার মধ্যে দিন কাটছে। বন্ধ হয়ে গেছে সন্তানদের পড়াশোনা। নতুন করে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রেও ভরসা রাখতে পারছেন না অনেকেই। অগ্নিকাণ্ডে হিসাবনিকাশের খাতা পুড়ে যাওয়ায় বাকি দেওয়া টাকাও উঠাতে পারছেন না তারা। নিঃস্ব ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘আগুন তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দিয়েছে। পুনর্বাসন প্রতিশ্রুতি ভাঁওতায় পরিণত হচ্ছে।’
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় নিঃস্ব হওয়া ব্যবসায়ীদের আহাজারি চলছেই। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অভিযোগ উঠে নাশকতারও। সময়ের সঙ্গে এমন অভিযোগ ঢাকা পড়ে যায়।
২০০৪ সালে রাজধানীর গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ১৮ বছরেও ক্ষতিগ্রস্তরা দোকান ফিরে পাননি। ১ হাজার ৬৪৬ জন ব্যবসায়ীর মধ্যে কেউই পুনর্বাসন হিসাবে কোনো দোকান বরাদ্দ পাননি। ওই সময় সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন-ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পুনর্বাসন করা হবে। ভস্মীভূত স্থানে ১২ তলা ভবন নির্মাণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের দোকান বানিয়ে দেওয়া হবে। ওই প্রতিশ্রুতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকাও নেওয়া হয়েছিল। ১৮ বছরে ওই স্থানে নেওয়া প্রকল্পে মাত্র চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে।
গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেট এখন কাগজেকলমে গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার হিসাবে পরিচিত। তবে সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতা ওই মার্কেটকে এখনো পুরান বাজার হকার্স মার্কেট বা পোড়া মার্কেট নামেই চেনে। ওই মার্কেট ঘেঁষে রাস্তায় এক যুগ ধরে ফল বিক্রি করেন জালাল মিয়া। জানালেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া গুলিস্তান মার্কেটে তারও একটা দোকান ছিল। টিনশেডের ওই মার্কেট পুড়ে যাওয়ার পর তার মতো শত শত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পথে বসে যায়। সিটি করপোরেশনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের (ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি) পুনর্বাসন করতে দোকান করে দিতে টাকাও নিয়েছিল। কিন্তু সেই পুনর্বাসন আর কবে হবে?
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ওই মার্কেটে প্রায় ১৭০০ ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের অধিকাংশই অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউ হতাশায় ভুগছেন। কেউ আবার গ্রামে কৃষিকাজ করছেন। কেউ ফুটপাতে ব্যবসা করছেন।
এদিকে সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, আগুনে ভস্মীভূত ওই মার্কেটের স্থানে নতুন একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন হচ্ছে। এ ভবনে ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যবসায়ীর জন্যও দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে।
গুলিস্তান মোড়ে পুরান টাকার ব্যবসা করেন আব্দুর রহিম। জানালেন, পুড়ে যাওয়া মার্কেটে তারও দোকান ছিল। তার মতো ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী গুলিস্তান ঘিরে ফুটপাতে ব্যবসা করছেন। কবে দোকান বরাদ্দ পাবেন জানেন না। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী মারাও গেছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ যুগান্তরকে বলেন, ২০০৪ সালে পুড়ে যাওয়া গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেট নতুন করে বহুতল ভবন করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। আমরা মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে আসছি। এ মার্কেটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে।
আর কত সময় লাগতে পারে-প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত ভবনটি নির্মাণের। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কষ্টের কথা বুঝি।
এদিকে ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় প্রায় সাড়ে চার হাজার ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ভস্মীভূত ওই মার্কেটে বহুতল ভবন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বহুতল ভবন নির্মাণ মানেই ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করা। ভবন নির্মাণের কথা বলে বছরের পর বছর নির্মাণকাজ করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মনোবল ভেঙে যায়। অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যান। অন্য পেশা শুরু করে। ভবন সমাপ্ত হওয়া খবর থাকে না সংশ্লিষ্টদের।
শনিবার ভোরে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে তিন তলাবিশিষ্ট মার্কেটের প্রায় সবকটি দোকানে থাকা মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘটনার পরপর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করেছেন-ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। প্রয়োজনে নতুন ভবন তৈরি করা হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে ওই মার্কেটের শত শত ব্যবসায়ী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলামসহ অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী জানান, গত কয়েক বছর করোনার কারণে বিক্রি ভালো হয়নি। এবার ঈদ সামনে রেখে ঋণ করে টাকা এনে বেশি মালামাল তুলেছিলেন তারা। সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সরকার কি সহায়তা করবে? দোকান কবে সাজাবেন, টাকা কোথায় পাবেন? এমন শত প্রশ্ন করেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী নেতা যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী গণমানুষের মার্কেটগুলো একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে মিশে যাচ্ছে। এমন ভয়াবহ ঘটনায় লাভবান হচ্ছে কারা? মার্কেটগুলো বিমার আওতায় আনা হয় না। ভবিষ্যতে এ ধরনের মার্কেটে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে বিমার ব্যবস্থাটি যুক্ত করা জরুরি। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না।
ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালাম মিয়ার ভাষ্য, পরপর মার্কেট পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে। এ যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। একেকটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের কী আসে যায়। এমন অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ হয়ে হইচই শুরু হয়। রাজনৈতিক বক্তব্য বাতাসে ভাসতে থাকে।
পরে সব ঢাকা পড়ে যায়। বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেট পুড়ে যাওয়ার ঘটনায়ও পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ভূরিভূরি প্রতিশ্রুতি আসছে। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবে তো? নাকি আগের প্রতিশ্রুতির মতো সবই ভাঁওতায় পরিণত হবে?