স্মারক বক্তৃতায় ড. আতিউর রহমান
আমাদের ব্যাংক খাত শক্তিশালী, এটা শুধু মুখের কথা নয়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক ধসে পড়লেও বাংলাদেশের ব্যাংক খাত টিকে আছে। কেননা আমাদের অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী। প্রকৃত অর্থনীতির কাছাকাছি আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত অবস্থান করছে। ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খুলে এবং ব্যাংককে মানুষের পকেট হিসাবে তৈরি করা হয়েছে। নানা দুর্নীতির প্রভাব এবং সুশাসনের অভাব থাকলেও স্বাধীনতার পর দেশের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এর ৬০ শতাংশ গত ১০ বছরে অর্জিত হয়েছে। এটা কোনো মুখের কথা নয়, অঙ্কের হিসাবের বিষয়। বুধবার ড. আব্দুল গফুর স্মারক বক্তৃতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এসব কথা বলেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ : পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্তের বিকাশ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. আতিউর রহমান। বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। এতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন। ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের মূল ভাগেই ছিলেন পূর্ববাংলার মধ্যবিত্তরা। এক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি আন্দোলনকারীর বাবা শহরে বাস করতেন। ৭০ শতাংশ আন্দোলনকারীর বাবা পাঁচ একরের বেশি জমির মালিক ছিলেন। এছাড়া ৬৮ শতাংশ আন্দোলনকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। নেতৃত্বে থাকা এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে গ্রাম ও কৃষক-শ্রমিকের গভীর সংযোগ ছিল। এ সংযোগ নিশ্চিত করতে যারা মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রাম থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্তদের ছিল শ্রমিক-কৃষকদের মতো অনিশ্চয়তার জীবন। নিজেদের পাকিস্তানি শাসকের অংশ মনে না করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোহনায় ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদের মধ্যে, যা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ব্যাপক সফলতা পায়। এ পথ বেয়েই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা আসে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়লেও তারা সাংস্কৃতিক চেতনায় নিমজ্জিত নয়। এখনকার মধ্যবিত্ত অনেক বেশি অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক হলেও কম সাংস্কৃতিক। মধ্যবিত্তরা স্ববিরোধী। টানাপোড়েনে কেউ নিচে নামে, আবার কেউ ওপরে ওঠে।
ড. আব্দুল গফুর সম্পর্কে ড. আতিউর রহমান বলেন, প্রকৃত অর্থেই আব্দুল গফুর একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। তার চিন্তা ও গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে প্রান্তজনের কল্যাণের অর্থনীতিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তিনি অন্যদেরও উৎসাহিত করেছেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়ে প্রচণ্ড সচেতন ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে তিনি সংগঠক হিসাবে ভূমিকা রেখেছেন।
ড. রেহমান সোবহান বলেন, রাষ্ট্রকে অভিজাত সমাজ কুক্ষিগত করছে। তারাই সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। সেখানে মধ্যবিত্তরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। সমাজে অগ্রণী ভূমিকা তারা রাখতে পারছে না। দিনকে দিন শিক্ষাক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে পড়ছে। দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রসার লাভ করা সত্ত্বেও তারা সেই সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে না। বরং তারা বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় মধ্যবিত্তদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেখা গেলেও এরপর সেই অবস্থান তাদের ধরে রাখতে দেখা যায়নি। পাকিস্তানিদের বৈষম্য থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু আজও সমাজে অন্য ধরনের বৈষম্য দেখা যাচ্ছে এবং তা ক্রমশ বাড়ছে।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, ষাটের দশকে মাত্র ৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। আন্দোলন-সংগ্রামে তারা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এখন মধ্যবিত্তদের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ হলেও তারা তখনকার মতো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এটা একটা বড় প্রশ্ন। তিনি আরও বলেন, গ্রাম থেকে শহরে মানুষ স্থানান্তরিত হলে শুধু শ্রমশক্তিই স্থানান্তরিত হয় না। এর মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই স্থানান্তরিত হয়।