Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

কক্সবাজার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিস

ভ্যাটের হাজার কোটি টাকা মিলেমিশে লোপাট

২৬০ কোটি টাকা ভ্যাটের বিপরীতে দিগুণ ঘুস আদায়ের অভিযোগ * জেনেও কিছু করার নেই দুদকের

Icon

জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভ্যাটের হাজার কোটি টাকা মিলেমিশে লোপাট

কক্সবাজার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট এবং হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহক থেকে আদায় করা ভ্যাটের হাজার কোটি টাকা মিলেমিশে লোপাট করার অভিযোগ উঠেছ। হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো মাসিক চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাট কর্মকর্তাদের ঘুস দিয়ে নামমাত্র ভ্যাট প্রদান করে যাচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কক্সবাজারে অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট ভ্যাট পরিশোধ করছে না। বেশিরভাগ হোটেলে অতিথিদের এন্ট্রি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করে না। রুম ভাড়ার তালিকা রাখে না। এছাড়া রেস্টুরেন্টগুলো ভ্যাট ফরমও ব্যবহার করে না। তারা ভ্যাট কর্মকর্তাদের মাসিক রেটে নির্দিষ্ট ভ্যাট পরিশোধ করে থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কর্মকর্তা হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে মাসিক অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। ভ্যাট ফাঁকি দিতে রাজস্ব কর্মকর্তাদের পরামর্শে বিক্রির একাধিক রেজিস্ট্রার রাখা হয়। একটি ভ্যাট অফিসের জন্য, অন্যটি মালিকপক্ষের জন্য। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।

এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পিলে চমকানো তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় অর্ধশতাধিক হোটেল মালিক ও সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেন যে ভ্যাটের চেয়ে তাদের দ্বিগুণ ঘুস প্রদান করতে হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তাদের। এর বিনিময়ে দুই থেকে তিনগুণ ভ্যাটের দায়মুক্তি পাচ্ছেন তারা। এবং ভ্যাট আদায়ের চেয়ে ঘুস আদায়ে তৎপর থাকার অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

কক্সাজারের পর্যটন শহরের তৃতীয় সারির একটি হোটেল আগস্টে প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি ভ্যাট প্রদান করেছে। তার বিপরীতে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের ঘুস দিতে হয়েছে দেড় লাখ টাকার বেশি। এরপরও হোটেলটির ২ লাখ টাকার বেশি সাশ্রয় হয়েছে। হোটেলটির হিসাবরক্ষকের তথ্যমতে, প্রতিবছর ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত ভ্যাট প্রদান করেন তারা। তবে এর বিপরীতে ঘুস দিতে হয় ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। এরপরও তাদের সাশ্রয় হয় দ্বিগুণ টাকা। অর্থাৎ ৩০ লাখ টাকারও বেশি হোটেলটি ভ্যাটের টাকা লোপাটের সুযোগ পাচ্ছে। হোটেল ম্যানেজারের দাবি, শুধু এই একটি হোটেল নয়। কক্সবাজার পর্যটন শহরের ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল, কটেজ ছাড়াও রেস্টুরেন্ট, স্বর্ণের দোকান ও বিপণিবিতানগুলোও একই পদ্ধতিতে ভ্যাট আদায় করে আসছে। সঙ্গত কারণে হোটেল এবং তথ্যদাতা ম্যানেজারের নাম গোপন রাখা হলো।

অভিযোগ আছে, শালিক রেস্টুরেন্টে প্রতিমাসে বিক্রি হয় দুই কোটি টাকা। সরকারের নির্ধারিত ১০ শতাংশ ভ্যাট দিলে দিতে হবে সাড়ে ২০ লাখ টাকা। অথচ কাস্টমস কর্মকর্তাদের মোটা অংকের ঘুসের বিনিময়ে মাসে মাত্র ১ থেকে দেড় লাখ টাকা ভ্যাট দেন তারা। আল গণি হোটেলের থানার সামনে এবং থানা রাস্তার মাথায় দুটি শাখায় প্রতিমাসে বিক্রি হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তারা সাড়ে ২৬ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা।

এছাড়াও পউষী রেস্টুরেন্টে মাসে বিক্রি হয় ১ কোটি টাকা। প্রতিমাসে ১৫ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ২ লাখ টাকা। ঝাউবন রেস্তোরাঁয় মাসে বিক্রি হয় ৫০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে সাড়ে ৭ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ১ লাখ টাকা। রূপসী বাংলা রেস্টুরেন্টে মাসে বিক্রি হয় ৫০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে সাড়ে ৭ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ১ লাখ টাকা। কড়াই রেস্টুরেন্টে মাসে বিক্রি হয় ৬০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে ৮ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ৮০ হাজার টাকা। মারমেইডে মাসে বিক্রি হয় ২ কোটি টাকা। প্রতিমাসে ৩০ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ১৫ লাখ টাকা। হোটেল অভিসারে মাসে বিক্রি হয় ৩০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ৮০ হাজার টাকা। সল্ট বিস্ট্রোতে মাসে বিক্রি ৯০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে সাড়ে ১৩ লাখ টাকার ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ৩ লাখ টাকা।

এ ছাড়াও জিপিধর (স্বর্ণের দোকান) মাসে বিক্রি হয় ৩ কোটি টাকা। প্রতিমাসে সাড়ে ২২ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ১ লাখ টাকা। রূপকৌশলী মাসে বিক্রি করে ৪ কোটি টাকা। প্রতিমাসে ৩০ লাখ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দেন মাত্র ৮০ হাজার টাকা। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।

গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম কার্যালয়কে কক্সবাজারের হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্টে ভ্যাট ফাঁকির বিষয় অনুসন্ধানে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত দল ৭টি হোটেলে অভিযান চালিয়ে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পায়। এর ভিত্তিতে ২৩ মার্চ প্রধান কার্যালয়ে এনফোর্সমেন্ট প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার সুবিধার্থে প্রায় হোটেল দুটি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করে। একটি রেজিস্ট্রার ভ্যাট কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততায় প্রকৃত আয় প্রদর্শন না করে সংরক্ষণ করা হয়। আরেকটি লুকায়িত অবস্থায় হোটেল-মোটেল ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের জন্য নির্ধারিত থাকে। কক্সবাজারের অন্য হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোরও একই অবস্থা। এতে সরকার প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৬০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করেছে কক্সবাজার কাস্টমস এক্সইজ ও ভ্যাটের সদর কার্যালয়।

দুর্নীতি প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করা সংগঠন আমরা কক্সবাজারবাসীর সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমরা তথ্য নিয়ে জেনেছি যে, রাজস্ব কর্মকর্তারা ভ্যাটের চেয়ে দ্বিগুণ ঘুস আদায় করে থাকেন। ঘুসের বিনিমিয় হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিকরা গ্রাহক থেকে আদায় করা আরও তিন থেকে চারগুণ ভ্যাট লোপাটের সুযোগ পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৬০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় বিপরীতে ভ্যাটের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঘুস আদায় করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঘুস দেওয়ার পরও গ্রাহক থেকে আদায় করা দুই থেকে তিনগুণ ভ্যাটের টাকা তাদের পকেটে ভরছেন। সে হিসাবে গ্রাহক থেকে আদায় করা ভ্যাটের হাজার কোটি টাকা মিলেমিশে লোপাট করেছে কক্সবাজারের রাজস্ব বিভাগ ও হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য মালিকরা।

অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজারের আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার যুগান্তরকে বলেন, আবাসিক হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট মালিকদের ভ্যাটের চেয়ে দ্বিগুণ ঘুস দেওয়ার স্বীকারোক্তি ও মিলেমিশে ভ্যাটের টাকা লোপাটের বিষয়টি তার জানা নেই।

কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি নাঈমুল হক টুটুল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মিলেমিশে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এটি খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক দুঃসময়ে সবার উচিত ভ্যাট সঠিকভাবে প্রদান করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকারের পাশে দাঁড়ানো। এ ঘটনা তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টদের উচিত সব প্রতিষ্ঠানকে ইএফডি মেশিনের আওতায় নিয়ে আসা এবং কঠোরভাবে মনিটরিং করা।

জেনেও কিছু করার নেই দুদকের : দুদকের সমন্বিত কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তা, হোটেল এবং রেস্তোরাঁ মালিকরা মিলেমিশে ভ্যাটের বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাটের বিষয়ে অভিযান ও অনুসন্ধান করে সত্যতা পেয়েছে দুদক। এরই প্রেক্ষিতে দুই বছর আগে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এবং অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে কমিশনে পাঠানো হয়। কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এটি অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

কমিশনে অনুমোদন না পেলে চোখের সামনে এভাবে প্রতিবছর ভ্যাটের হাজার কোটি টাকা লুটপাট রোধে দুদকের করণীয় কি এমন প্রশ্নের উত্তরে, দুদক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার কিছু করার নেই হাত-পা বাঁধা। এ বিষয়ে চেষ্টা করেও দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে, কিছু রাজস্ব কর্মকর্তা এবং ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশে ভ্যাটের বড় একটি অংশ লুটপাট করে থাকেন। যা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আর লুটপাটের অঙ্ক যদি হাজার কোটি টাকা হয় তাহলে বলব দেশের অর্থনীতি হুমকিতে। আবার এর ব্যর্থতার দায় সরকার কোনোভাবে এড়াতে পারে না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এসব থেকে বোঝা যায় যে, দুদকের কিছু লোক দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। যথাসময় যদি দুর্নীতিবাজ ও ভ্যাটের টাকা লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা না যায়। তাহলে এই লুটপাট বন্ধ হবে না। তারা উৎসাহিত হয়ে নির্ভয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তাই ভয় উপেক্ষা করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

অভিযোগ স্বীকার করে নিজেদের সফল বলে দাবি রাজস্ব কর্মকর্তাদের : ২৬০ কোটি টাকা ভ্যাটের বিপরীতে দিগুণ ঘুস আদায় ও ঘুসের বিনিময় দুই থেকে তিনগুণ ভ্যাট ফাঁকির সুযোগ দিয়ে মিলেমিশে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজার সদর সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা, বরং আমি রাত-দিন পরিশ্রম করে ও অনেকটা জোর জবরদস্তি করে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ভ্যাট আদায় করেছি।

একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কক্সবাজার বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ ছৈয়দুল আলম খুদে বার্তায় বলেন, এসব অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন। কোভিড ১৯-এর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরও ভালো রেভিনিউ আদায় হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব সার্কেল থেকে ইএফডি মেশিন নজরদারি করা হচ্ছে।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম