রেলের পশ্চিমাঞ্চল
হাসপাতাল ক্রয় খাতে সাত কোটি টাকার অনিয়ম
খরচের ক্ষেত্রে বিল-ভাউচার খুঁজে পায়নি নিরীক্ষা কমিটি
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের হাসপাতালগুলোয় বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় খাতে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। সরকারি ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে বিপুল পরিমাণ এই টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক অতিরিক্ত ব্যয় দেখানোর ঘটনা ঘটেছে। সরকারি নিরীক্ষায় সম্প্রতি এই বিপুল অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ব্যয়িত অর্থ আদায়সহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হাসপাতালগুলোয় ব্যয়িত অর্থের নিরীক্ষা গত বছর সম্পন্ন করে মন্ত্রণালয়ের একটি অডিট টিম। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মহাপরিচালকসহ অধীন বিভিন্ন দপ্তরপ্রধানদের কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরাদ্দ, ব্যয় ও ক্রয়সংক্রান্ত নথিপত্র নিরীক্ষায় দেখা যায়, কোনো কমিটি গঠন ছাড়াই দাপ্তরিক ব্যয় প্রস্তুত করে সরঞ্জাম ও সহায়ক উপকরণ ক্রয় করেছেন। বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ দামে কেনা হয়েছে উপকরণ। সরকারি ক্রয় নীতিমালার ব্যাখ্যা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিপিআর-২০০৮, বিধি-১৬ উপবিধি ৫(ক) অনুযায়ী ক্রয়কারী নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে ক্রয়ের দাপ্তরিক ব্যয় হিসাব করবেন। কিন্তু এই নিয়ম অনুসরণ না করে অনিয়মিতভাবে ১ কোটি ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৩২৩ টাকার কেনাকাটা সম্পন্ন করা হয়েছে। ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি গঠন ও ব্যয় প্রাক্কলন ছাড়া সরকারি খাতের কোনো কেনাকাটা করা গুরুতর অনিয়মের পর্যায়ে পড়ে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) কার্যালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রাথমিক ও সংশোধিত, চূড়ান্ত বাজেট বরাদ্দ এবং চূড়ান্ত ব্যয় বিবরণী অনুযায়ী প্রাপ্ত টাকার বিপরীতে অতিরিক্ত ৩ কোটি ৯৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৫৫ টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বিল রেজিস্টার অনুযায়ী ব্যয়ের সপক্ষে খরচের বিল-ভাউচার দেখাতে পারেনি সিএমও দপ্তর। একইভাবে রেলওয়ের বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার, পাকশী বিভাগ কার্যালয়ে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় খাতে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ৫ কোটি ৯০ লাখ ৫৫১ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু খরচের ক্ষেত্রে বিল-ভাউচার খুঁজে পায়নি নিরীক্ষা কমিটি। রেলের পাকশী হাসপাতালের ডায়েট, ওয়াশিং এবং কর্মচারীদের পোশাক কেনায় অতিরিক্ত ১৫ লাখ ৯ হাজার ২১১ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়। কিন্তু অতিরিক্ত এই টাকা খরচেরও কোনো খাত নেই।
এদিকে মোটরযান মেরামত কাগজপত্র ছাড়াই মাত্র একটি বছরে সিএমও কার্যালয়ের গাড়ি মেরামত কাজে খরচ দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ৯২ টাকা। কিন্তু মেরামতসংক্রান্ত নথি, চাহিদাপত্র ও কোনো বিল-ভাউচার নিরীক্ষা কমিটি পায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, দপ্তরপ্রধান বছরে একটি গাড়ি মেরামতের জন্য সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারবেন। এই সীমা অতিক্রম করলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সিএমও দপ্তর কোনো সরকারি অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে মেডিকেল বিভাগের রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতাল ও ডিসপেনসারির চাহিদা ছাড়াই স্লিপ বই ছাপা খাতে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। নিরীক্ষা টিম বলেছে, রেলের নিজস্ব ছাপাখানায় না ছাপিয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে ছাপানোসহ বই কেনা হয়েছে। এ খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ লাখ টাকা। অনুমোদন ছাড়া এভাবে অর্থব্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের বিপরীতে ১৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬৫৭ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। চূড়ান্ত ব্যয় বিবরণী পর্যালোচনায় নিরীক্ষা টিম দেখেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অনুন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের কয়েকটি খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ অপেক্ষা সিএমও এবং ডিএমও কার্যালয় বেশি খরচ করেছে। চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও সিএমও পশ্চিম এবং ডিএমও পাকশী, সৈয়দপুর ও লালমনিরহাট কার্যালয়ের জন্য ৪৮টি উলেন কম্বল কেনা হয়। সিফাত এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাজারদরের তুলনায় উচ্চমূল্যে কম্বলগুলো সরবরাহ নেওয়া হয়। এতে সরকারের ৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এক খাতের বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে অন্য খাতের মালামাল কেনা হয়েছে। এতে আর্থিক কোড লঙ্ঘন করা হয়েছে। সিএমও এবং ডিএমও কার্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পোশাক কেনা হয়েছে আরেকটি খাতের টাকায়। ফলে এ খাতে ৩১ লাখ ২৪ হাজার ২৬৮ টাকা খরচে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষায়িত পণ্য ও সেবা না হলেও দেশে সহজলভ্য স্যানিটারি সামগ্রী উন্মুক্ত দরপত্র (ওটিএম) পদ্ধতিতে না ক্রয় করে স্থানীয় (এলটিএম) পদ্ধতিতে কেনা হয়েছে। স্যানিটারি সামগ্রীর হালনাগাদ বাজারমূল্য বিবেচনায় এই ক্রয় খাতে ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আলোচিত অর্থবছরে ১০ হাজার ৭০০ লিটার ফিনাইলের দাম পরিশোধ করা হয়েছে ২১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। নিরীক্ষা ব্যাখ্যায় বলা হয়, বাজারে ফিনাইলের লিটারপ্রতি দাম ৫০ টাকা। এর সঙ্গে ভ্যাট ও কর মিলে ৯ শতাংশ এবং ঠিকাদারের ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ করলে মূল্য দাঁড়ায় ৭০ টাকা লিটার। প্রতি লিটার ফিনাইলে ১৪০ টাকা করে অতিরিক্ত ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে। এ খাতে অতিরিক্ত ১৪ লাখ ২৭ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে। সেই সঙ্গে ১২০ টাকা কেজি দরের ব্লিচিং পাউডার কেনা হয়েছে ২৫০ টাকা করে। অতিরিক্ত দামে ব্লিচিং কেনায় রেলের ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ ২৭ হাজার টাকা, যা পরিশোধ করা হয়েছে। এদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে উপযুক্ত টেকনিশিয়ান না থাকা সত্ত্বেও ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছে ইসিজি মেশিন।
মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষায় বিপুল অঙ্কের অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলের তৎকালীন প্রধান মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. এএসএম এমতেয়াজ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিরীক্ষা ও আইসিটি) লুৎফর রহমান বলেন, আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপকের ব্রডশিট পাঠানোর কথা। তার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলছেন, অডিট আপত্তির বিষয়ে এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে বলতে পারব। তবে নিষ্পত্তির সুপারিশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় ব্রডশিট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা হয়। এটিও বড় সমস্যা। এ কারণে পশ্চিমাঞ্চলে এখনো তিন হাজার অডিট আপত্তি বছরের পর বছর পড়ে আছে।