পুলিশের মাদক নিরাময়কেন্দ্র ওয়েসিস
সুস্থ জীবনে ফেরার হার প্রায় শতভাগ
এক বছরেই স্বাভাবিক জীবনে শতাধিক ব্যক্তি, পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের এ প্রতিষ্ঠানটির প্রশংসা রোগীদের মুখে মুখে
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্পেনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করেন চল্লিশোর্ধ্ব আরিফুর রহমান (ছদ্মনাম)। পারিবারিক অস্থিরতা থেকে একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন মাদকে। ১০ বছর ধরে বিভিন্ন মাদক নিরাময়কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু সুফল আসেনি।
একপর্যায়ে তিনি ভর্তি হন পুলিশের অধীন পরিচালিত মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শকেন্দ্র ওয়েসিসে। এখানে চিকিৎসা নেন টানা চার মাস। চিকিৎসা শেষে ছয় মাস আগে তিনি বাসায় ফেরেন। পুরোপুরি সুস্থ। মাদকের নেশা এখন আর তাকে টানে না। বরং নিজে মাঝেমধ্যে ওয়েসিসে এসে কাউন্সেলিং করেন চিকিৎসাধীন মাদকাসক্তদের।
ওয়েসিসের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আরিফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘এককথায়-অসাধারণ। আমার সন্তুষ্টি শতভাগ। খাওয়াদাওয়া, ডাক্তার-নার্সদের আচার-আচরণ সবই ভালো। সবাই রোগীর প্রতি হেল্পফুল। চাপ দিয়ে কোনো কিছু করানো হয় না। তবে সুনির্দিষ্ট রুটিন আছে। সেই রুটিন অনুযায়ী সবাইকে চলতে হয়। সব নিরাময়কেন্দ্রে এরকম পরিবেশ থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।’
মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শকেন্দ্র ওয়েসিসের তদারকির দায়িত্বে থাকা পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘কয়েক বছরের মধ্যে মানিকগঞ্জে আরও একটি অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সেখানে ইতোমধ্যে ১০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। আরও জমি কেনা হবে। ওই কেন্দ্রটিতে সুইমিংপুল এবং গার্ডেনসহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। প্রস্তাবিত কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে সময় লাগবে।
এজন্য আপাতত কেরানীগঞ্জে প্রকল্পটি শুরু করেছি। সম্পূর্ণ অলাভজনক এই সেবা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। আশা করছি, এর সফলতা অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি শুরুর আগে আমরা বিদ্যমান ৩০টি মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র ঘুরে দেখি। ওইসব কেন্দ্রে যেসব ত্রুটি চোখে পড়েছে, এই কেন্দ্রে সেসব ত্রুটি রাখা হয়নি।’
প্রসঙ্গত, রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রিভারভিউ প্রকল্পে গত বছরের ৭ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয় এই মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র। সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে। এটি উন্মুক্ত রয়েছে সর্বসাধারণের জন্য। এখানে সার্বক্ষণিক দুইজন এডিকশন কাউন্সিলর এবং একজন করে এফসিপিএস সাইকিয়াটিক ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট ও ফিজিও থেরাপিস্ট দায়িত্ব পালন করেন। চারজন এমবিবিএস ডাক্তার পালাক্রমে রোগী দেখেন। এছাড়া আছেন পাঁচজন নার্স ও ১২ জন ওয়ার্ড বয়। একজন পুলিশ সুপারের (এসপি) নেতৃত্বে এখানে কর্মরত আছেন ৫৫ জন। কেবল একজন রোগীই না, গত এক বছরে ওয়েসিস থেকে সুস্থ হয়েছেন শতাধিক মাদকাসক্ত। এছাড়া সুস্থ জীবনে ফেরার হার প্রায় শতভাগ।
সরেজমিন ওয়েসিসে গিয়ে জানা যায়, ৬০ শয্যাবিশিষ্ট এই কেন্দ্রের বিশেষত্ব হচ্ছে, ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা। চিকিৎসা নিয়ে রোগী চলে যাওয়ার পরও রোগীদের কাউন্সেলিং এবং ডোপ টেস্ট করা হয় বিনামূল্যে। নারী রোগীদের জন্য এখানে আছে স্বতন্ত্র চিকিৎসাব্যবস্থা। এখান থেকে যারা সুস্থ হন, তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিরাময়কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা হয়। সাত তলাবিশিষ্ট আধুনিক এই মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে আছে ২২টি রুম। পুরুষদের জন্য ১৬টি রুমে আছে ৪৬টি শয্যা। মহিলাদের ছয়টি রুমে শয্যা আছে ১৪টি। ডাবল কেবিন ২৮টি, ট্রিপল কেবিন ১৫টি এবং জেনারেল ওয়ার্ডে আছে ১১টি বেড। এছাড়া জেনারেল ট্রিপল বেড আছে ছয়টি। জেনারেল ওয়ার্ড ছাড়া সব ওয়ার্ড বা কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
ওয়েসিসের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সুশান্ত দে যুগান্তরকে বলেন, ‘রোগীদের জন্য প্রথম তিন সপ্তাহ থাকে ডি-টক্স রিয়িড (ওষুধের মাধ্যমে নেশামুক্ত করার প্রক্রিয়া)। এরপর থাকে লাইফ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম। এর আওতায় প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নানা সেশন থাকে। দিনের শুরুতে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে গ্রুপ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। গ্রুপ কাউন্সেলিংয়ের ভিত্তিতে শুরু হয় ইনডিভিজুয়াল কাউন্সেলিং। ইনডিভিজুয়াল কাউন্সেলিংয়ের ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয় ফ্যামিলি কাউন্সেলিং। এ সময় রোগীর অভিভাবক বা স্বজনরা উপস্থিত থাকেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মিত মানসম্মত খাবারের পাশপাশি রোগীর ধরন অনুযায়ী বিশেষ খাবার সরবরাহ করা হয় ওয়েসিসে। সকাল ৮টায় মর্নিং প্রেয়ারের মাধ্যমে রোগীদের দিন শুরু হয়। মর্নিং প্রেয়ারে সবাই সারা দিন ভালো থাকার প্রার্থনা করেন। সকাল সাড়ে ৮টায় নাশতা। ৯টায় ডাক্তারের ভিজিট। ১১টায় গ্রুপ সেশন। বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত দুপুরের খাবার। বিকাল সাড়ে ৪টায় ফের গ্রুপ সেশন। সকালের গ্রুপ সেশনে এফসিপিএস ডাক্তার থাকলে বিকালে থাকেন সাইকোলজিস্ট।
বিকাল ৫টায় সবার জন্য ভবনের ছাদবাগান উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেখানে কেউ গান গায়, কেউ গিটার বাজায়, আবার কেউ হাঁটাহাঁটি করেন। মাগরিবের নামাজের পর শুরু হয় ইনডোর গেমস, লাইব্রেরি ওয়ার্ক এবং ছবি দেখার পালা। রাত ৮টা পর্যন্ত যে যার মতো সময় কাটিয়ে চলে যান ডাইনিং টেবিলে। প্রত্যেকের রুমেই আছে ব্যক্তিগত ডাইনিং। রাতের খাবার শেষে রোগীরা টিভি দেখার সুযোগ পান। ঘুমাতে যাওয়ার আগে রোগীদের রুমে রুমে পৌঁছে দেওয়া হয় হালকা নাশতা ও দুধ।
ওয়েসিস মাদক নিরাময়কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া মোস্তাক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি ওয়েসিসে পাঁচ মাস ছিলাম। মাস দুয়েক আগে সেখান থেকে রিলিজ নিয়েছি।’ তিনি জানান, ‘হতাশা থেকে আমি মাদকে জড়িয়ে যাই। দুই বছর ধরে ইয়াবাসেবন করতাম। মাদকাসক্তির কারণে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন ভালো আছি। আমার সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। সিরাজগঞ্জে থাকি। মাঝেমধ্যে ওয়েসিস থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিই। যখন যে ধরনের সহযোগিতা চাচ্ছি, তা সেখান থেকে পাচ্ছি।’
ইমরান নামের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র জানান, ‘বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ি। গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়েসিসে ভর্তি হই। ছয় মাস সেখানে ছিলাম। এর আগে দুইটি রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ওয়েসিসে ভর্তি হওয়ার পর আমি সুফল পাই। এখানকার চিকিৎসাসেবাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আমি মুগ্ধ।’