যানজটে বাড়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি
শ্বাসকষ্ট, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় * যানজটের বিরক্তি থেকে সংসার ভাঙার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
দীর্ঘ যানজটে সময় ও আর্থিক ক্ষতি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত ক্ষতি কম নয়। দীর্ঘক্ষণ যানজটে পড়ে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে ও উদ্বেগ বাড়ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুস ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মারাত্মকভাবে শব্দ ও বায়ুদূষণও হচ্ছে। এতে যাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। নিয়মিত যানজটের বিরক্তি থেকে মানুষের সংসার ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ এবং স্নায়বিক ক্ষতির অন্যতম কারণও অতিরিক্ত যানজট বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যানজট রোধে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আগামীতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে পৌঁছবে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা যুগান্তরকে জানান, স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার কারণে অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনছেন। এ মুহূর্তে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৭৬ শতাংশের বেশি। অধিকাংশ সড়ক ব্যক্তিগত গাড়ি দখল করে থাকে। ঢাকায় যানজটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এখানকার যানবাহনের চলার গতি বর্তমানে মানুষের হাঁটার গতির সমান বলে একটি গবেষণায় উঠে এসছে। অথচ এক দশক আগেও ঢাকায় যানবাহনের চলার গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সেখান থেকে নামতে নামতে এখন ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে সদরঘাটগামী একাধিক গণপরিবহণ চালক যুগান্তরকে বলেন, আগে এ রুটে যানজটে আটকে পড়ার গড় হিসাব ছিল ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মতো। এখন সেটি বেড়ে ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মতো হচ্ছে। মঙ্গলবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে সাভার থেকে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে আসেন আমেনা জামান। কিন্তু নিউমার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের জেরে মিরপুরগামী রাস্তায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে গাবতলী থেকে কলেজ গেট পর্যন্ত আসতে তাদের দুই ঘণ্টা লেগে যায়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় বাসা থেকে বের হয়ে দুপুর সোয়া ১২টায়ও তারা হাসপাতালে পৌঁছতে পারেননি। তিনি বলেন, গাড়ির অনেক যাত্রী হেঁটে রওয়ানা দিলেও অসুস্থ বাবাকে নিয়ে তাকে বাসের ভেতর থাকতে হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, যানজটে পড়ে সময় ও আর্থিক ক্ষতির চিন্তায় অনেক যাত্রী চালক-হেলপারের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হলেও তারা তা বুঝতে পারেন না। কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যানজটে সৃষ্ট মানসিক চাপে অনেকের হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি মুমূর্ষু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত রাস্তায় আটকে থাকায় রোগী ও অভিভাবকদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছেন রান্নাঘরের ধোঁয়ায়। এরপর যানজটে আটকা পড়ে মানুষ ধোঁয়াদূষণের শিকার হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের শরীরে প্রতি মিটার কিউবে গড়ে ১০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত দূষণ সহনীয়। রাজধানীর বাসিন্দাদের গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম বায়ুদূষণ সহ্য করতে হচ্ছে। আর যানজটে আটকা পড়লে সেটি প্রতি মিটার কিউবে ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ডব্লিউএইচের বর্তমান গাইডলাইনের চেয়ে ঢাকা নগরবাসীকে ৬০ শতাংশের বেশি দূষণ সহ্য করতে হচ্ছে। এতে ফুসফুস ও প্রস্টেটগ্রন্থির ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা জিপজোটের গবেষণা অনুযায়ী-বিশ্বে মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান সপ্তম। এর প্রধান কারণ হিসাবে যানজটকে দেখানো হয়েছে। একইভাবে কানাডার সেন্টার ফর ড্রাগ অ্যাডিকশন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ (সিডিএএমএইচ) এক গবেষণা বলেছে-যানজটের মানসিক চাপ নিয়মিত গ্রহণ করলে মানসিক অস্থিরতা তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ। নিয়মিত যানজটের বিরক্তি থেকে মানুষের সংসার ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময়মতো কোথাও পৌঁছানোর কথা থাকলেও যানজটে পড়ে কেউ পৌঁছতে না পারলে তার মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়। এতে তার শরীরে স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণে ঘাম হয়, হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, অস্থিরতা বোধ হয়। গাড়ি থেকে যাত্রী নেমে যেতেও চান। এ ধরনের তাৎক্ষণিক মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তিনি আরও বলেন, নিয়মিত দীর্ঘ যানজটে বসে থাকায় কাজের ক্ষতি, সময়মতো কাজ করতে না পারা, আর্থিক ক্ষতি-এসব কারণে উদ্বেগ তৈরি হয়। যানজটে পড়ে মানুষের মধ্যে ক্রোধ, আক্রমণাত্মক, মারমুখী, অস্থির, খিটখিটে আচরণ দেখা দেয়। খিটখিটে মেজাজ ও উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে। যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকায় শারীরিক-মানসিকভাবে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এছাড়া চালকদের অযথা হর্ন বাজানোর প্রবণতায় উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। এভাবে দীর্ঘদিন চললে বিষণ্নতা, হতাশা ও কাজের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা চলে আসে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ‘ফন্ট্রিয়ারস-২০২২ : নয়েজ ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে-বর্তমান ঢাকা শহরের শব্দের গড় তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বেশিরভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। যা বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করছে। ঢাকায় গাড়ি চালকরা হর্ন বাজিয়ে মারাত্মক শব্দ ও বায়ুদূষণ করছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, যানবাহনের ধোঁয়ায় বিষাক্ত সিসার উপস্থিতি থাকে। এক জায়গায় অনেক গাড়ি আটকে থাকায় সেগুলো থেকে একত্রে নির্গত ধোঁয়ায় ‘ইন-কমপ্লিট কমবাস্টন’র সৃষ্টি হয়। এতে কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সিন, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার অক্সাইড বাতাসের সঙ্গে মিশে মানুষের ফুসফুসে চলে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ গ্যাস মিশ্রিত দূষিত বাতাস গ্রহণ করলে ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফুসফুসের রোগ যেমন-হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) ও ইন্টারস্টিসিয়াল লাং ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ে। এমনকি ফুসফুসে ক্যানসারও হতে পারে। এছাড়া যানজটে গর্ভবতী মায়ের লেবার পেইন ও হার্টের রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আরও বলেন, যানজটের বাতাসে উচ্চমাত্রার সিসা মানুষের স্নুয়ুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন সিসাযুক্ত বাতাস গ্রহণ করলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যায়, কিডনি, হৃদযন্ত্র, প্রজননতন্ত্রের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ এবং স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকার চারপাশে চারটি বড় নদী থাকলেও যানজট নিরসনে সেগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। দূষণের সম্মিলিত নেতিবাচক প্রভাবে ঢাকা শহর একটি অসুস্থ নগরে পরিণত হচ্ছে। সুস্থ জাতি গঠনে এখন যানজট, শব্দ-বায়ু-পানি দূষণ রোধে সবাই মিলে কাজ করতে হবে।