রেলে পাথর নিক্ষেপ আতঙ্ক
মহিউদ্দিন মিশু, আখাউড়া
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
চলন্ত ট্রেনে ‘পাথর নিক্ষেপ’ যাত্রীদের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে হতাহত হচ্ছেন গার্ড, চালক ও যাত্রীরা। এক বছরে পূর্বাঞ্চল রেলপথে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা শতাধিক। পাথর নিক্ষেপে মুত্যৃর ঘটনাও ঘটছে। আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মনতলা স্টেশনের আউটারে বুধবার দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে গুরুতর আহত হন সহকারী ট্রেনচালক তৌহিদুল মুরসালিন। ইঞ্জিন কক্ষের গ্লাস ভেঙে তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান। তিনি তেলবাহী ট্রেন নিয়ে সিলেট থেকে আখাউড়া আসছিলেন।
রেলওয়ে কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুতেই সহকারী ট্রেনচালক তৌহিদুল আহত হন। ২০২১ সালে আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশন হয়ে চট্টগ্রাম-সিলেট, ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-ঢাকা, সিলেট-ঢাকা রেলপথে চলন্ত ট্রেনে শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে আখাউড়া অভিমুখী তিতাস কমিউটার ট্রেনে রাত পৌনে ১০টায় আখাউড়া রেলসেকশনের পাঘাচং স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তের ছোরা পাথরে জসিম উদ্দিন নামে এক যুবক গুরুতর আহত হন। গত বছরের ৭ জানুয়ারি সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কুমিল্লার গোমতি ব্রিজ পার হওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা পাথর নিক্ষেপ করে। এতে চার যাত্রী আহত হন। মৃত্যুর ঘটনা আছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী তূর্ণা-নিশীথা ট্রেনে। ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট ট্রেনটি সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী এলাকায় পৌঁছার পর পাথরের আঘাতে মারা যান চুয়েটের এক ছাত্রী। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী গোধূলী এক্সপ্রেস ট্রেন আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনে প্রবেশকালে দক্ষিণ আউটার সিগন্যাল এলাকায় লাদেন (২০), হৃদয় (১৯) এবং আতিক (২০) ওই ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। রেলওয়ে পুলিশ ওই তিন যুবককে আটক করে।
গেল বছর ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকাগামী আন্তঃনগর কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে আহত হন সহকারী ট্রেন চালক কাওসার আহমেদ। এ ঘটনার ১৫ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে রেলওয়ে পুলিশ। একই এলাকায় পাথরের আঘাতে মমতাজ মারোয়া নামে এক যাত্রী গুরুতর আহত হন। গত ২ অক্টোবর ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেসে পাথরের আঘাতে অন্তত চার যাত্রী আহত হন।
২০২০ সালে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বারবার ঘটেছে। ২০১৯ সালে পাথরের আঘাতে শিশু যাত্রী জিসান গুরুতর আহত হয়। এর আগের বছর পাথরের আঘাতে রেলওয়ের টিআই শিকদার বায়েজিত মৃত্যুবরণ করেন। পূর্বাঞ্চল রেলে পাথর নিক্ষেপে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নিহত হওয়ার পর রেল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছিল। ওই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ট্রেনে দুষ্কৃতকারীরা ইচ্ছা করেই পাথর নিক্ষেপ করে। বিগত সময়ে পাথর নিক্ষেপকারীদের কয়েকজন আটক হলে সেই সত্যতা বেরিয়ে আসে। বছরের পর বছর ডাকাতি ও ট্রেনের ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যেও এ বর্বর কর্মকাণ্ড ঘটছে। অথচ কেউ যেন রেললাইনের ধারেকাছে না আসতে পারে, সেজন্য ১৪৪ ধারা বলবৎ আছে। গত বছর পূর্বাঞ্চলের শুধু ঢাকা বিভাগে ৪৯টি চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ডিসেম্বরে আখাউড়া থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত আটটি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। আহত হন অর্ধশতাধিক যাত্রী। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হন অন্তত ১০ জন। ক্ষতিগ্রস্তরা কোনো ক্ষতিপূরণ পান না।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের যে জায়গাগুলো থেকে ট্রেনে পাথর ছোড়া হয় সেগুলো ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আখাউড়া রেলওয়ে আউটার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, কুমিল্লায় দক্ষিণ আউটার, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড, ফেনীর ফাজিলপুর-কালীদহ এবং নরসিংদীর নরসিংদী, জিনারদী ও ঘোড়াশাল এলাকা। সূত্র জানায়, চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চল রেলে পাথর ছোড়ার ঘটনা বেশি পাঁচ জেলায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ ‘স্টোন থ্রোয়িং’ বা পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ৩০টিরও বেশি স্পটে।
নেপথ্যে চোরাকারবারিরা : রেলওয়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় বেশির ভাগ মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের হাত রয়েছে। রেলওয়ের একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগে বা স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর ট্রেনের গতি কমিয়ে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রেন থামিয়ে অবৈধ মালামাল নামানো হয়। এসব ক্ষেত্রে মাদক পাচারকারীরা নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করতে থাকে। কোনো কারণে যদি ট্রেন ওই স্থানে না থামে, তখন তারা পাথর নিক্ষেপ করে। নির্জন স্থানগুলোতেই পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি।