মামলাশূন্যের প্রতিযোগিতা ঢাকা রেঞ্জে
৯৬ থানার ২৩টিতেই নেই অপমৃত্যু মামলা
পুলিশের ১৬০ বছরের ইতিহাসে প্রথম- টানা ১২ মাস কোনো থানায় মামলার সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিট * কোনো থানাতেই নেই ৬ মাসের ঊর্ধ্ব তদন্ত মুলতবি
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মামলাশূন্যের প্রতিযোগিতা চলছে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জে। এ রেঞ্জের ২৩ থানাতে কোনো অপমৃত্যু মামলা তদন্তাধীন নেই। অপমৃত্যুর যেসব মামলা হয়েছিল সেসবের তদন্ত ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এছাড়া তিনটি থানাতে নেই নিয়মিত মামলা। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে কোর্ট পিটিশন মামলাও। কোনো থানাতেই ৬ মাসের ঊর্ধ্বে মামলা তদন্ত মুলতবি নেই। বর্তমানে ১৩ জেলার ৯৬টি থানায় ৪৪৩টি মামলা তদন্তাধীন আছে। কোনো মামলার তদন্তই ৬ মাস অতিক্রম করেনি। শুধু তাই নয়, টানা ১২ মাস ধরে কোনো থানায় মামলার সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার নজিরও স্থাপিত হয়েছে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ এ ইউনিটে। যা পুলিশের ১৬০ বছরের ইতিহাসে প্রথম। অথচ এক সময় মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর ঝুলে থাকত নিয়মিত মামলার তদন্ত। অনিষ্পন্ন থাকত অপমৃত্যুর মামলা। কয়েকটি থানার ওসি এবং রেঞ্জ অফিসের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা রেঞ্জের থানাগুলোতে কোর্ট পিটিশনের মামলা তদন্তাধীন ছিল পাঁচ হাজারের বেশি। এসব মামলা কমে এখন দাঁড়িয়েছে দেড় হাজারে। যেসব থানায় এখন অপমৃত্যুর মামলা শূন্যের কোটায় রয়েছে সেগুলো হলো- মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, মানিকগঞ্জের শিবালয়, হরিরামপুর ও দৌলতপুর, নরসিংদীর পলাশ, মাধবদী, রায়পুরা ও মনোহরদী, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও নিকলী, টাঙ্গাইলের গোপালপুর, ভূয়াপুর, বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব, নগারপুর ও ধনবাড়ী, ফরিদপুরের সালথা, রাজবাড়ীর বালিয়াকাইন্দ ও কালুখালী, মাদারীপুরের কালকিনি, ডাসার, শিবচর ও রাজৈর এবং শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ। এছাড়া যে তিন থানায় নিয়মিত মামলা নেই সেগুলো হলো- হরিরামপুর, দৌলতপুর ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া।
হরিরামপুর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, আমার থানায় যেসব নিয়মিত মামলা তদন্তাধীন ছিল সেসবের তদন্ত গত মাসেই শেষ করে ফেলেছি। চলতি মাসে হওয়া একটি অপহরণ মামলা এখন পেন্ডিং আছে। এটিরও তদন্ত দ্রুত শেষ করে ফেলা হবে।
দৌলতপুর থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, আমার থানায় যেসব পেন্ডিং মামলা ছিল সেসবের তদন্ত জুনে শেষ করেছি। জুলাইয়ে হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচটির তদন্ত চলমান। এগুলোর তদন্ত শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না। তিনি বলেন, গত বছরের জানুয়ারিতে আমি দৌলতপুর থানার ওসি হিসাবে যোগ দিই। ওই সময় আমার থানায় ৩৪টি মামলার তদন্ত পেন্ডিং ছিল। একদিন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার আমাকে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেন। এরপর ওই বছরের মে মাস থেকেই তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনি। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে কোনো মামলায় চার্জশিট, আবার কোনো মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। টানা ১২ মাস তদন্তাধীন বা পেন্ডিং মামলা সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার পর ১৩তম মাসে এসে থানায় মামলার সংখ্যা শূন্য করে ফেলি। পুলিশের জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত এটি একটি রেকর্ড।
এক প্রশ্নের উত্তরে ওসি আরও বলেন, আমার থানায় দুজন পরিদর্শক, ৮ জন এসআই এবং ৭ জন এএসআই। এ ১৭ জন কর্মকর্তাসহ অন্যান্য ফোর্সদের যথাথভাবে কাজে লাগানোর কারণেই সফলতা এসেছে।
টুঙ্গীপাড়া থানার ওসি এএসএম নাসিম বলেন, জুনে আমি আমার থানায় তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছিলাম। জুলাইয়ে হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে দুটি এখন পেন্ডিং আছে। শূন্যের কোটায় আনার আগের ৩-৪ মাস এ থানায় তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিটে ছিল। এক প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, আমি বছর দেড়েক আগে এ থানায় যোগদান করি। তখন পেন্ডিং মামলার সংখ্যা ছিল ২০টির বেশি। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভালো পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে জনসংযোগের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে বিট পুলিশিং যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে। বিট পুলিশিংয়ের কারণে মামলা হওয়ার আগেই অনেক অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করে ফেলা হচ্ছে। এতে করে থানায় দালালদের তৎপরতা কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমার থানাটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকা। এই এলাকাটি জাতির পিতার পুন্যভূমি। তাই আমি মনে করি, জনগণকে সঠিক সেবা দেওয়া আমার পবিত্র দায়িত্ব। রেঞ্জ ডিআইজির সার্বক্ষণিক মনিটরিং এ দায়িত্বকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মাত্র দুজন পরিদর্শক, ১০ জন এসআই এবং সাতজন এএসআই দিয়ে থানাকে পেন্ডিং মামলা মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নূরেআলম মিনা যুগান্তরকে বলেন, থানাগুলোতে যাতে অযথা কোনো মামলা পেন্ডিং না থাকে সে বিষয়ে ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, যথাসময়ে ভিসেরা ও রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়াসহ নানা কারণে আগে তদন্তকাজে বিলম্ব হতো। তাই এ বিষয়ে ২০১৯ সালে রেঞ্জ অফিস থেকে বিশেষ সেল গঠন করে রিপোর্ট সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এএসপি তাইজুল ইসলামের নেতৃত্বে চারজনের একটি টিম এ বিষয়ে কাজ করছে। এ সেল থেকে যথা সময়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর (ঢাকায় অবস্থিত) থেকে ভিসেরা-রাসায়নিক রিপোর্ট সংগ্রহ করে বিশেষ ডাকে থানাগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে তদন্তকাজে বেশ গতি বেড়েছে। গত দুই বছরে রেঞ্জ অফিসের বিশেষ সেল দুই হাজার ২২টি ভিসেরা রিপোর্ট এবং ১৭ হাজার ৮৮৬টি মাদক পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। এর মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে অতিরিক্ত ডিআইজি নূরে আলম মিনা জানান।
