পল্টনের ফ্ল্যাটে কারখানা
জাল লাখ টাকার বান্ডিল ১০ হাজার টাকায় বিক্রি
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় গোপনে জাল টাকার রমরমা ব্যবসা করছে প্রতারকরা। জাল নোটের লাখ টাকার বান্ডিল ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকায় কিনে প্রতারক চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। জাল নোট দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করছে। নানা সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জাল টাকার প্রতারক চক্রের সদস্যরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে তারা জামিনে বেরিয়ে আসছে। কারাগার থেকে বেরিয়েই তারা আবার জাল নোটের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। তিন ধরনের জাল নোটের খোঁজ পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান জানান, পুরানা পল্টনের দুটি ফ্ল্যাটে দেড় মাস ধরে প্রতারকরা জাল টাকা তৈরি করে আসছিল। প্রতিদিন সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ এবং সর্বনিম্ন তিন লাখ টাকা তৈরি করা হতো। নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে চক্রের সদস্যদের কাছে প্রতারকরা এক লাখ টাকার জাল নোটের বান্ডিল ১০ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি করত। এরপর চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় তা ছড়িয়ে দিত। আর খুচরা বিক্রেতারা কিনে সেগুলো ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজারে ছড়িয়ে দিত। ১৪ আগস্ট রাজধানীর ২৫/২ পুরানা পল্টন লেনের একটি ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার দুটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ৫৭ লাখ জাল টাকা এবং ৫-৬ কোটি টাকার জাল নোট তৈরির সামগ্রী জব্দ করে। এ সময় প্রতারক চক্রের সদস্য হান্নান, কাওসার, আরিফ, ইব্রাহিম ও খুশিকে গ্রেফতার করা হয়। তবে জাল টাকার মূল হোতা ও একাধিক মামলার আসামি শাহিনকে পুলিশ ধরতে পারেনি।
ডিসি মশিউর রহমান আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে প্রতারক চক্র পল্টনের মতো জায়গায় কারখানা গড়ে তোলে। ১৮ জুলাই রাতে আন্তঃজেলা নোট জালিয়াত চক্রের হেতাসহ তিনজনকে ডিবি সদস্যরা গ্রেফতার করেন। তারা হল- গ্যাং লিডার মো. সাইফুল (৩২), তার দুই সহযোগী মো. রুবেল (২৮) ও আলম হোসেন (২৮)। ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানি পশুরহাটে তারা জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ অভিযানে প্রায় ৩৫ লাখ টাকার জাল নোট, জাল নোট তৈরির মেশিন, একটি ল্যাপটপ, একটি লেমিনেটিং মেশিন ও রঙ উদ্ধার করা হয়।
ডিবির লালবাগ ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার রাজিব আল মাসুদ জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে আলম হোসেনকে বংশাল এলাকা থেকে তিন লাখ টাকার জাল নোটসহ গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আলম জানায়- তাদের গ্যাং লিডার সাইফুল কেরানীগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়িতে জাল নোট তৈরি করছে। এরপর ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাইফুল ও রুবেলকে ৩২ লাখ টাকার জাল নোটসহ গ্রেফতার করা হয়। রাজিব আল মাসুদ জানান, এরপর আমরা জানতে পারি প্রতারক হাবিব মোল্লা, জীবন, মুজিবর ও রানা বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে। আগেও আমরা তাদের গ্রেফতার করেছিলাম। কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়ে তারা আবারও একই কাজ করতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরেকটি সূত্র জানায়, ৫ বছর আগে রাজধানীর অভিজাত ধানমণ্ডি এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফরিদপুরের সাইফুল ইসলাম ‘টাকশাল’ গড়ে তোলে। কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই তিনি কোটি কোটি টাকার জাল নোট তৈরি করছিল। জানুয়ারিতে কদমতলী থেকে দুই লাখ টাকার জাল নোটসহ প্রতারক শাহ আলমকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর সাইফুলের নাম সামনে চলে আসে। এরপর ধানমণ্ডির ৭/এ সড়কের একটি ফ্ল্যাটে র্যাব-১০-এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ‘টাকশাল’র সন্ধান পান। তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাট থেকে কোটি টাকার বেশি জাল নোটসহ সাইফুলকে আটক করা হয়। ফ্ল্যাট থেকে কোটি টাকার বেশি মূল্যের ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। এ সময় জাল টাকা তৈরির কাগজ, প্রিন্টার, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন উপাদান জব্দ করা হয়। তখন সাইফুল র্যাবকে জানায়, ২০ বছর ধরে সে জাল টাকা তৈরির কাজ করছে। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে সাইফুল আবার জাল টাকার কারখানা খুলে বসেছে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর কদমতলীর রাজবাড়ি, ডেমরার বাঁশেরপুল ফরমান খাঁ মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া রামপুরা, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোটের কারখানায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জাল টাকার প্রতারকদের দমন করা সম্ভব নয়। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাড়ির মালিককেও ভাড়াটিয়া সম্পর্কে জেনেশুনে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হবে। এছাড়া পাশের ভাড়াটিয়ারও ভূমিকা আছে। তাদেরও সচেতন হতে হবে। সবার সচেতনতাই পারে জাল টাকার কারবারিদের রুখতে।
তিন ধরনের জাল নোটের ছড়াছড়ি : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত তিন ধরনের জাল নোটের অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে ‘ওয়াশ নোট’ নামের জাল নোটের কদর সবচেয়ে বেশি। আসল ১০০ টাকার নোট দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। ১০০ টাকার নোট প্রথমে রাসায়নিক দিয়ে সাদা করা হয়। এরপর প্রিন্টারের মাধ্যমে ৫০০ টাকার জাল নোট বের করা হয়। এক লাখ টাকা মূল্যমানের এ ‘ওয়াশ নোট’ বিক্রি হয় ৪০-৫০ হাজার টাকায়। এছাড়া অন্য নোটগুলো বিক্রি হয় প্রতি লাখ ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকায়। আর খসখসে কাগজে তৈরি এক লাখ টাকা মূল্যমানের এক হাজার টাকার জাল নোট ২৫-৩০ হাজার টাকা বিক্রি হয়।
সূত্র জানায়, রাজধানীতে জাল টাকা তৈরির কারিগরদের মধ্যে সগির, কামাল, হুমায়ূন কবির, কাওসার, মাহবুব মোল্লা, আলাউদ্দীন, বাবু, লিয়াকত হোসেন জাকির, রহিম বাদশা সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তারা গ্রেফতার হলেও ছাড়া পেয়ে আবার পুরনো ‘পেশায়’ নামে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি উৎসবের আগে জাল নোট তৈরিতে চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভেজাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতাও চলে। যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, সেটার দামও তত বেশি। জাল টাকা তৈরি ও বিক্রিতে চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে কাজ করে। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে এবং অপর গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়। তৃতীয় গ্রুপ জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
