পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প : অগ্রগতি ৩০ শতাংশ
সময়ে শেষ করাই চ্যালেঞ্জ
২৫৫ চীনা কর্মকর্তা-প্রকৌশলী অনুপস্থিত * সেতু উদ্বোধনের দিন ট্রেন চালানো নিয়ে সংশয় * প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বেড়েছে
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। কিন্তু কমলাপুর থেকে গেণ্ডারিয়া-মাওয়া হয়ে সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণে নেয়া ‘পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প’ বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হওয়ার কথা। দ্বিতীয় বারের মতো ব্যয় ৭৮০ কোটি টাকা বাড়ানোয় প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পে প্রায় ২২ কিলোমিটার রেলপথ হবে উড়াল। উড়াল রেলপথে ৫৭৫টি পিলারের (৩ থেকে ২৫ মিটার উঁচু) মধ্যে ৪২টি পিলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৩০ শতাংশ।
মূল প্রকল্পের মধ্যে মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথ ২০২১ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা। অর্থাৎ সেতু উদ্বোধনের দিন বিভিন্ন যানের সঙ্গে ট্রেন চলারও কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মাওয়া থেকে ভাঙ্গা সেকশন পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার লাইন স্থাপন কাজ মাত্র ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্র্রকল্পটিতে প্রায় ৯শ’ চীনা কর্মকর্তা-প্রকৌশলী ও শ্রমিক কাজ করছেন। চীনে নতুন বছর উদযাপন করতে যাওয়া প্রায় ২৫৫ কর্মকর্তা-প্রকৌশলী করোনাভাইরাসের কারণে এখনও পর্যন্ত ফিরে আসেননি। এর ফলে প্রকল্প কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, ‘কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ রেলওয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন বিভিন্ন যানের সঙ্গে ট্রেনও চালানো হবে। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আমরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার রেলপথ ২০২১ সালের মধ্যেই শেষ করব। চীনা কর্মীরা যদি আগামী ১-২ মাসের মধ্যে না ফেরেন- তাহলে চলমান প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কাজের অগ্রগতি কমে আসবে। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, শুরুতে ৪২ কিলোমিটার রেল লাইন স্থাপনসহ পুরো প্রকল্পটিই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে। এজন্য প্রতিটি পদেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।’ রেলপথ মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরুর (১২ ডিসেম্বর ২০১৫) প্রায় ৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর রেল লিংক প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্প মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সাল। পরে ২০১৯ সালে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। প্রথমে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ করতে চাচ্ছে রেল। এ কারণে বাকি ১৩০ কিলোমিটার অংশের কাজ কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। এদিকে ৪২ কিলোমিটার পথে ট্রেন চালাতে কেনা হচ্ছে যাত্রীবাহী কোচ (বগি) ও ইঞ্জিন।
মূল প্রকল্পটির চিফ ইঞ্জিনিয়ার (ব্রিজ ভায়াটেক) নাজনীন আরা কেয়া জানান, রেলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও অত্যাধুনিক এ প্রকল্পের কাজ দ্রুততার সঙ্গে চলছে। চীনের কর্মকর্তা-প্রকৌশলীদের অনুপস্থিতি নিশ্চয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিন্তু নির্মাণ কাজ থেমে নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই শ্রমিকরা কাজ করছেন। পুরো প্রকল্পের কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। কমলাপুর থেকে গেণ্ডারিয়া হয়ে শ্যামপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ডাবল ডুয়েল গেজ লাইন হচ্ছে। আর এ স্টেশনের আউটার থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার উড়াল রেল লাইন তৈরি হচ্ছে। এ রেলপথে কেরানীগঞ্জ ও ধলেশ্বরী নদীতে দুটি মেজর রেল ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। আরও ৬ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ হচ্ছে পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে। আমাদের খাল-বিল ধরে এ প্রকল্পে নির্মাণ কাজ করতে হচ্ছে। ৬ দশমিক ১৮ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর নির্ধারিত স্থানে ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণসহ ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন স্থাপন হচ্ছে। নাজনীন আরা কেয়া আরও জানান, সেকশন-১ ঢাকা থেকে গেণ্ডারিয়া পর্যন্ত ডাবল ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ হচ্ছে। সেকশন-২ গেণ্ডারিয়া থেকে মাওয়া পর্যন্ত উড়াল লাইনের জন্য ৪১৯টি পিলার নির্মাণ হচ্ছে। উড়াল লাইনের বাকি ১৫৬টি পিলার পদ্মা সেতুর দু’পাশের লাইনে নির্মাণ হবে। সেকশন-৩ এর অংশ মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার রেলপথ আগে নির্মাণ করা হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এ অংশের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হচ্ছে ঠিক, তবে পুরো প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে কাজ চলছে। সেকশন-৪ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে মাটি ভরাটসহ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পিলার বসানোর কাজটিও খুব চ্যালেঞ্জিং। খাল-বিলের মধ্যে এসব পিলার নির্মাণ করতে হচ্ছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে।’
রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাওয়া-ভাঙ্গা সেকশনের কাজে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় পুরো প্রকল্পে এর প্রভাব পড়ছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই এ সেকশনে ট্রেন চালাতে হবে- এমনটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নীতিনির্ধারকরাই জানেন। উদ্বোধনের দিন থেকেই যদি অন্তত ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা যাওয়া যেত তাহলে- যাত্রী সুবিধা নিশ্চই বাড়ত।’ অন্য এক কর্মকর্তা বললেন, ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কৌশল পাল্টিয়ে একইদিন সেতু দিয়ে যান ও ট্রেন চালানো নিশ্চয় একটি চ্যালেঞ্জ।’
এদিকে পুরো প্রকল্প সমাপ্তের পরপরই যেন ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালানো যায়- সেজন্য ১০০ ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ ও ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। এ লাইনে ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় ঢাকা থেকে যশোর পৌঁছানো সম্ভব হবে যাত্রীদের। ট্রান্স এশিয়া রেলওয়ে রুটে অন্তর্ভুক্তির জন্য এ প্রকল্পটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রকল্পটি সমাপ্ত হলে নতুন করে ২৩টি জেলা রেলওয়ের আওতায় আসবে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল- চীনা কর্মীদের নিয়ে। ইতিমধ্যে যারা চীনে নতুনবর্ষ উদযাপনের জন্য গিয়েছেন তারা এখনও আসেননি। প্রায় ২৫৫ জন কর্মকর্তা- প্রকৌশলী এখনও কাজে ফেরেননি। তাদের ফিরতে দেরি হলে পুরো প্রকল্পের কাজে নেতিবাচত প্রভাব পড়বে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ করতে পারব। একইদিনে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেনও চালানো সম্ভব হবে।