
প্রিন্ট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০১ এএম
ট্রান্স ফ্যাটজনিত মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন নীতিমালার
খাবারে সর্বোচ্চ মাত্রা হতে হবে মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
ট্রান্স ফ্যাট চর্বির একটি প্রাথমিক উৎস। এতে রক্তে মন্দ কোলেস্টেরলের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়ে, যা হৃদরোগজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া ট্রান্স ফ্যাট টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেকোনো খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ পর্যন্ত সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হলেও বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। এক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ও সরকারের ইতিবাচক মনোভাব প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০০৬ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্যালরিভিত্তিক পরিমাপে খাবারের মধ্যে অন্য যেকোনো কিছুর তুলনায় ট্রান্স ফ্যাটের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ- একজন ব্যক্তির দৈনিক ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির ১ শতাংশের কম। জানা গেছে, বাংলাদেশে শিল্পোৎপাদিত কোনো মোড়কজাত খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় না। তবে সম্প্রতি ঢাকার স্থানীয় বাজারে দৈবচয়নের মাধ্যমে সংগৃহিত ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুটি নিয়ে এক গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণায় বিস্কুটগুলোতে ৫ থেকে ৩৯ শতাংশ ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণার ফলাফল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
ট্রান্স ফ্যাট এক প্রকার হাইড্রোজেনেটেড অয়েল। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্য তেল বা চর্বিও ট্রান্স ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। সিঙ্গাড়া, সমুচা, পুরি, বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের মতো বেকারি পণ্য যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থাকে সেগুলো তৈরিতে হাইড্রোজেনেটেড অয়েল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনেক স্ট্রিট ফুড যেগুলো কড়া করে ভাজা হয় সেগুলোতেও ট্রান্স ফ্যাট থাকে। এছাড়া রান্নার কাজে একই তেল বারবার ব্যবহার করলেও তাতে ট্রান্স ফ্যাট উৎপাদিত হয়।
মার্কিন জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমী ২০০২ সালে এক রিপোর্টে জানায়, ট্রান্স ফ্যাট শরীরে কম ঘনত্বের কোলেস্টেরলের (এলডিএল) পরিমাণ বাড়ায়। এলডিএল কোলেস্টেরলকে মানুষের শরীরের জন্য ‘মন্দ কোলেস্টেরল’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ এটা হৃদরোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন (এফডিএ) ১৯৯৯ সালে প্রথম খাবারের মোড়কের গায়ে পুষ্টি তথ্যের সঙ্গে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণও উল্লেখ করার বিষয়টি প্রস্তাব করে, যা কার্যকর হয় ২০০৬ সাল থেকে। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু হার কমাতে এফডিএ ‘ট্রান্স ফ্যাট’ নিষিদ্ধ করে।
২০০৩ সালে ডেনমার্ক বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আইন করে এর সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশ নির্ধারণ করে। অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইরান, ভারতসহ ২৮টি দেশে খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেছে। ফলে এসব দেশে খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া আরও ২৪টি দেশ খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করেছে।
এমনকি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ও কানাডা ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস ‘পিএইচও’ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মহসিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিচালক রোগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে আইন করা উচিত। কারণ একটি আইন থাকলে এটি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা যুগান্তরকে বলেন, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপসহ অসংক্রামক রোগ থেকে নিরাপদে থাকতে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তবে এর জন্য পৃথক আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের যে আইন রয়েছে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে সেটিই যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তবে এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেন বলেন, দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ট্রান্স ফ্যাটের ব্যবহার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত মাত্রায় আনতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় না গিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলেই হবে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্ব দিতে হবে।