তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রকল্প
৫ কোটি টাকার ‘স্পেলিং চেকার’ নিয়ে বুয়েট ও রিভ সিস্টেমসের হরিলুট

মিজানুর রহমান সোহেল
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:২০ পিএম

সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনস্থ বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ১৫৯ কোটি টাকার ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পটি নিয়ে শুরু থেকেই নানান অভিযোগ উঠেছে।
‘বাংলা প্রোজেক্ট’ নামে পরিচিত এই প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পুর্ণাঙ্গ বাংলা করপাস উন্নয়ন, কথা থেকে লেখা ও লেখা থেকে কথায় রূপান্তর সফটওয়্যার উন্নয়ন, বাংলা ফ্রন্ট রূপান্তর ইঞ্জিন, বাংলা যান্ত্রিক অনুবাদক উন্নয়ন, স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার উন্নয়নসহ মোট ১৬টি বিষয়ের ওপর কাজ করা হয়। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ।
২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হাতে রয়েছে পুরো প্রকল্পটি। বুয়েটকে কারিগরি বা টেকনিক্যাল কনসাল্টেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় বিসিসি। পরবর্তীতে বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষক টার্মস অব রেফারেন্সেস (টিওআর) লেখার নাম করে মূল্যায়ন কমিটিও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
তারই অংশ হিসেবে প্রাথমিক অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিভ সিস্টেমসকে ১৪ কোটি ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬০ টাকার তিনটি কাজ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ‘স্পেলিং অ্যান্ড গ্রামার এরোর চেকার’ প্রকল্পের জন্য বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ৪০০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভ্র, নিকষ বাংলা (সরকারি অর্থায়নে তৈরি), অঙ্কুর, মজিলা অ্যাড অন, শুদ্ধ শব্দ, সৃষ্টি, গুগলসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান অফলাইন ও অনলাইনে বিনামূল্যে বাংলা স্পেলিং চেকার সেবা দিচ্ছে। সেখানে প্রায় একই জিনিস তৈরি করার জন্য নেয়া হচ্ছে সাড়ে ৫ কোটি টাকার চেয়েও বেশি।
কাজের তুলনায় বাজেট অনেক বেশি: স্বীকার করলেন রিভ সিস্টেমসের সিইও
কাজের তুলনায় বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে সেটা স্বীকার করে রিভ সিস্টেমসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আজমত ইকবাল যুগান্তরকে বলেন, ‘ওদের সঙ্গে যদি তুলনা করেন তাহলে বলবো ওদের কাজের তুলনায় এটার বাজেট অনেক বেশি। কিন্তু এখানে কাজের স্কোপ আছে যেটা কিনা ওদেরটাতে নেই।’
তিনি বলেন, ‘অভ্র বা এই জাতীয় সফটওয়ারে তারা যেটা করে সেটার নাম ‘‘নন ওয়ার্ড এরোর’’। নন ওয়ার্ড এরোর মানে হচ্ছে আপনি একটি টাইপ করলেন কিন্তু সেটা ডিকশনারিতে যদি না থাকে তাহলে সেটাকে এরোর হিসাবে দেখাবে।’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরুন, আপনি যখন লিখবেন- তুমি ভাত খান। তুমির সঙ্গে কিন্তু খান শব্দটা যায় না। এটাকে বলে কনফ্লিকচুয়াল এরোর। কনফ্লিকচুয়াল এরোরে বিশাল মেশিন লার্নিং কাজ রয়েছে। তারা (ফ্রি প্রতিষ্ঠানগুলো) কিন্তু কনফ্লিকচুয়াল এরোর ব্যবহার করে না।’
প্রকল্পের অগ্রগতি কতদূর?
প্রকল্পের বিষয়ে আজমত ইকবাল বলেন, ‘বাংলা প্রকল্পের মোট বাজেট ১৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে কিছু কাজ আমরা পেয়েছি। সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের এই কাজটির একটা অংশ রয়েছে বুয়েটের সঙ্গে। তারা এটা টেস্ট করবে। এরপর তিন বছর আমাদের মেইন্টেইনসে থাকবে।’
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলা স্পেলিং গ্রামার দেড় বছরের প্রকল্প। এটার জন্য আরও ৮ মাস সময় আছে এবং আমরা এই সময়ের মধ্যে আশা করছি কমপ্লিট করতে পারবো। তবে এটার বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে।’
বুয়েটকে কারিগরি বা টেকনিক্যাল কনসাল্টেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় বিসিসি। বুয়েট তো মূল্যায়ন কমিটিতেও রয়েছে। তারা কি কেউ এই প্রকল্পের সঙ্গে থাকতে পারে? উত্তরে আজমত বলেন, ‘তারা থাকতে পারে না। আমরা ডেভেলপমেন্ট শেষ করার পরে তারা প্রোজেক্টের পক্ষ থেকে টেস্ট করে দেবে। তারা কাজটা বুঝে নেবে। কিন্তু ডেভেলপমেন্টে তারা আমাদের সঙ্গে নেই।’
বাংলা প্রোজেক্ট নিয়ে রিভ সিস্টেমসের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই
বুয়েটের এই প্রোজেক্টের মূল বিষয়ের (ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ে) অভিজ্ঞতা অতি সীমিত। অথচ কুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। মূল্যায়ন কমিটিতে কেন তাদের কাউকে রাখা হলো না? বিসিবি বা মন্ত্রণালয়কে বোকা বানিয়ে রিভ সিস্টেমস এবং বুয়েট সিন্ডিকেট অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়নি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আগে এই নিয়ে কাজ করেছে। তারাই এটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তারপরেও তাদের নেয়া হলো না কেন? এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রিভ সিস্টেমসের সিইও আজমত বলেন, এই প্রজেক্টে তারা আমাদের সঙ্গে নেই। তবে তারা আমাদের সঙ্গে পরবর্তীতে অন্য একটি প্রকল্পে কাজ করার কথা রয়েছে।’
আপনাদের সঙ্গে কোনো ইউনিভার্সিটি কাজ করছে কিনা? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলা স্পেলিং গ্রামারে আমার যতটুকু মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাঙ্গুয়েজ ডিপার্টমেন্ট রয়েছে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ রয়েছে। এরা কাজ করছে ল্যাঙ্গুয়েজ পার্টে।’
বাংলা প্রকল্প নিয়ে আগে কাজ করার তেমন অভিজ্ঞতাও নেই রিভ সিস্টেমসের। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে তারা বাংলা ভাষার ‘কথাকে বোঝা’ নিয়ে কাজ করেছে। সেই প্রকল্পটির মূল কাজ হচ্ছে- প্রশ্ন বুঝতে পারা এবং টিটিএসের মাধ্যমে প্লে করে শোনানো। এই মডেল নিয়ে ২০১৬ সাল থেকে রিভ কাজ করছে বলে দাবি করেছে। এর বাইরে বাংলা প্রোজেক্ট সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুই করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
বুয়েটের লুকোচুরি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) একদিকে রিভ সিস্টেমসের টেন্ডার বানানোর কাজ করছে। অন্যদিকে মূল্যায়ন কমিটিতে বসে নম্বরও দিচ্ছে। কয়েকবার এসব বিষয় প্রমাণিত হয় বুয়েটের অনেক শিক্ষক রিভ সিস্টেমসের সঙ্গে প্রকাশ্যে কাজ করছেন। এই নিয়ে অভিযোগ উঠলে বুয়েট ও রিভ সিস্টেমস সতর্ক হয়ে যায়।
ইতিমধ্যেই সাড়ে ১৪ কোটি টাকার কাজ সফলভাবে রিভ সিস্টেমসকে দিতে সক্ষম হয়েছে বুয়েট। আইসিটি মন্ত্রণালয় বা বিসিসি কেনই বা কারিগরি বা টেকনিক্যাল কনসাল্টেন্ট এবং মূল্যায়ন কমিটিতে নিয়োগ দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলা প্রোজেক্টের যে কাজ রিভ সিস্টেমসকে দেয়া হয়েছে সেটার ডেভেলপমেন্ট বা সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে বুয়েট কাজ করছে কিনা? এমন প্রশ্ন করলে বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইসি) বিভাগের প্রধান ড. মো. মোস্তফা আকবর সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।
তবে তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছে বুয়েটের আলাদা আলাদা টিম ২০টি মডিউল নিয়ে কাজ করছে।
মোস্তফা আকবর যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের একটা টিম কাজ করছে। আপনি যদি আমাদের ডিপার্টমেন্টে একদিন সরাসরি আসেন তাহলে (যারা এই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছে) তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। ফোনে এত কথা বলা যাবে না। এখানে ২০টি মডিউল নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। প্রতিটি মডিউল নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। আপনি আসুন আগে। এরপর কথা বলা যাবে।’
যার তত্ত্বাবধায়নে কাজটি হচ্ছে তার সেল নম্বর পাওয়া যাবে কিনা? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখানে একেকটি মডিউল একেক জনের দায়িত্বে রয়েছে। আপনি আসেন। আমি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’
পরের দিন তার নির্ধারিত সময়ে বুয়েটে পৌঁছে তাকে ফোন করা হলে তার অফিস রুমে আসতে বলেন। কিন্তু যাওয়ার পর আর তার দেখা মেলেনি। একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার একজন সহকারী জানালেন, যে প্রকল্পের বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন সেটা নিয়ে কাজ করেন প্রফেসর মো. মনিরুল ইসলাম। তার সঙ্গে কথা বলুন।
মনিরুল ইসলামকে বেশ কয়েকবার কল করার পর পাওয়া গেল। তবে বাংলা প্রোজেক্ট নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি অনেকটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন।
তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে দেখা করতে হলে আপনাকে আগে থেকে সময় নিতে হবে এবং ‘‘অফিশিয়াল চিঠি’’ নিয়ে আসতে হবে। এভাবে কথা বলা যাবে না।’ চিঠিটি কিসের, কোথা থেকে নিতে হবে? প্রশ্ন করতেই তিনি লাইন কেটে দেন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুয়েটের একজন শিক্ষক জানালেন, ‘বুয়েটের একটি শক্তিশালী সক্রিয় সিন্ডিকেট সরকারের বাংলা প্রজেক্টের দেড় শত কোটি টাকা নানানভাবে হরিলুট করার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে রিভ সিস্টেমসের সঙ্গে প্রথম ডিলে গিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা অনুসন্ধান করলে কেঁচো খুঁজতে সাপ বেরিয়ে আসবে।’
বাংলা প্রকল্প নিয়ে সরকারের মনোভাব কী
‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্প নিয়ে সরকারের মনোভাব কী? এ বিষয়ে জানতে প্রকল্পের প্রোজেক্ট ডিরেক্টর (পিডি) ড. মো. জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে গিয়ে জানা গেল তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
তবে এই প্রকল্পের কনসালটেন্ট মোহাম্মাদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। আগামী মাসে পিডি দেশে ফিরলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে তিনি অনুরোধ করলেন।
বাংলা প্রোজেক্ট নিয়ে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে যুগান্তরের কয়েক দফায় কথা হয়েছে। তবে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য মূলত কম্পিউটিং জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্প্রসারণে কাজ শুরু করা। প্রকল্পের শুরু থেকেই এর সঙ্গে ছিলাম। এখন প্রকল্পটি নিয়ে যা হচ্ছে তাতে আমি সন্তুষ্ট নই; বিরক্ত।’
পরের পর্ব-
বাংলা ওসিআর নিয়ে আবারও কেলেঙ্কারি