Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

শাস্তি নিশ্চিত করে ধর্ষণ রুখতে হবে

Icon

রুকাইয়া সাওম লীনা

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শাস্তি নিশ্চিত করে ধর্ষণ রুখতে হবে

পৃথিবী ক্রমশ সভ্যতার দিকে ধাবিত হলেও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ আমাদের সমাজে এখনো নিয়মিত ঘটছে! গত দুমাসে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ৭৭৪টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সব খবর কি আমরা জানতে পারছি? নাকি অনেক খবর বরাবরের মতো চাপা পড়ছে লোকলজ্জা, সমাজব্যবস্থা ও বিচারহীনতার ভয়ে!

ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ ঘটে চলছে আদিকাল থেকেই। ধর্ষকের বিচার যদি নিশ্চিত করা যায় তবে তা অপরাধীর অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করবে। অপরাধীকে সাজা পেতে দেখলে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা অপরাধ সংঘটিত করার ব্যাপারে ভয় পাবে। যুগ যুগ ধরে যে কোনো সামাজিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয় নারী ও শিশুরা। সেটা হতে পারে মানসিক ও অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক। যার মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। মানুষের মনোবলকে ভেঙে দিতে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ধর্ষণের ঘটনা মূলত যেসব কারণে ঘটে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পুরুষের পেশিশক্তি প্রকাশের প্রবণতা! আছে নারীর প্রতি সহিংসতার আসক্তি, নারীর মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং পূর্ববর্তী অপরাধের বিচারহীনতা। সেই সঙ্গে পারিবারিক শিক্ষা বা আরও স্পষ্ট করে বললে সুশিক্ষার অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সমাজে নারীকে অপরাধী চোখে দেখা, নারীর শরীর ও তার ব্যক্তি জীবনকে গুরুত্ব না দেওয়া, নারীর শরীরকে শুধু ভোগ্য মনে করা থেকেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল বলেন, ‘একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে বলতে পারি, ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে হবে তা শুধু আমাদের আজকের চাওয়া নয়, এটা আমাদের সব সময়ের চাওয়া। ধর্ষণের বিচার যে হয় না, তার জন্য কতগুলো ব্যাপার আছে। যেমন একটি হলো-যিনি ধর্ষণের শিকার হন কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজের লজ্জা, এক ঘরে করে দেওয়ার ভয়, অনেকে নিজ পরিবারকেও পাশে না পাওয়ার কারণে বিচারের আশা ছেড়ে দেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবার ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে ওই এলাকা ছেড়ে যায় বা বাসা পরিবর্তন করে ফেলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারী ভাবেন, লোক জানাজানি হলে তিনি স্বাভাবিকভাবে আগের মতো সমাজে বিচরণ করতে পারবেন না। তাছাড়া তাকে বারবার আদালতে দৌড়াতে হবে। একে তো ভিকটিম ট্রমাটাইজ, অপরদিকে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে তাকে বারবার লজ্জিত হতে হবে ভেবে তিনি বিচার চাওয়া থেকে সরে আসেন। অপরদিকে ধর্ষণের পর আলামত খুবই বড় একটা প্রমাণ। কিন্তু অজ্ঞতার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তা নষ্ট হয়ে যায়। যেমন যদি গোসল করে ফেলে তবে আলামত শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। আসলে সবাই এ বিষয়ে সচেতনও নয়। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা যার জীবনেই ঘটুক না কেন, এর বিপরীতে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা সবাই জানেন না বললেই চলে। পুরুষ তাদের পাওয়ার এক্সারসাইজ করার জন্য, তাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য, এমনকি প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলেও ধর্ষণ করে থাকে। এছাড়া পারিবারিক, রাজনৈতিক, সম্পত্তি নিয়ে কলহের জের ধরে বিরোধী পরিবারের নারী বা কন্যাসন্তানকে ধর্ষণ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষ সবল আর নারী দুর্বল, তাই সে ধর্ষণের শিকার হয়। যেমন কারখানা বা অফিসের মালিক বা বস; বাসাবাড়িতে যারা কাজ করেন সেসব বাড়ির মালিক; পরিবারের কাছে আত্মীয়কেও ধর্ষক হিসাবে দেখা যায়। আর এসব বাহুশক্তি ও ক্ষমতাশালীদের দৌরাত্ম্যে ভিকটিম আর বিচারের আশা করতে পারে না। বাংলাদেশে আইন আছে, আইনের প্রয়োগও আছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতা একটা বড় কারণ, যার জন্য নারী বা তার পরিবার বিচার প্রক্রিয়া এড়াতে চায়। ফলে এ গুরুতর অপরাধটা বিচারহীন হয়ে পড়ে অনেক সময়। আমি সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে মনে করি এগুলোই যথাযথ কারণ বিচারহীনতার। যা থেকে আমাদের বের হয়ে আশার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি রাষ্ট্রকেও বা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এসব অপরাধ দমনে আরও সজাগ হতে হবে। অপরাধপ্রবণ পুরুষকেও আরও সভ্য হতে হবে। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’

বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়া আর আলোর মুখ দেখে না। ভিকটিম বিচারের আশা ছেড়ে দেন। যার জন্য ভিকটিম বিচারব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ধর্ষণপরবর্তী ধর্ষণের শিকার নারীর শারীরিক ও মানসিক বেদনা ও টানাপোড়েন, তার নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা তাকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দেয়। এ সময় আমরা যদি তাকে মানসিক সাপোর্ট দিতে পারি, তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করতে পারি এবং সর্বোপরি বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা নির্মূল করতে পারি, যা নির্মূল করতে সক্ষম হলে আমরা ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হব। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সবার আগে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ যে কোনো অপরাধ নির্মূলে রাষ্ট্রের ভূমিকাই অগ্রগণ্য।

ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে যেসব ব্যবস্থা নিতে হবে-

১) ধর্ষিতাকে শারীরিক ও মানসিক সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

২) বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা রোধ করতে হবে।

৩) ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারের সামাজিক অবস্থানকে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪) ধর্ষণপরবর্তী আলামত সংরক্ষণের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫) প্রতিটি ঘটনা মনিটরিং করার জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি করতে হবে।

৬) ধর্ষণের একটি অপরাধও যেন আইনের ফাঁক গলে বের না হতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

৭) স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে প্রতিটি ধর্ষণের অপরাধকে মুক্ত রাখতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম