অচলায়তন
পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি ও আমাদের করণীয়
রওনক জাহান
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমানে আমরা নতুনত্বে মোড়া ও অনিশ্চয়তায় ঘেরা এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখনো অন্য অনেক কিছুর মতোই নারীর অধিকারও সংকটাপন্ন অবস্থায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সব সময়ের মতো যেমন যে কোনো জরুরি অবস্থায় নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন কিংবা জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বেড়ে যায় বা ধরন পালটে যায়, ঠিক তেমনই একটা সময়ের সাক্ষী হচ্ছি আমরা।
২০১৫ সালের জাতীয় নারীর প্রতি সহিংসতা (ঠঅড) জরিপের তুলনায় সাম্প্রতিক তথ্য ইঙ্গিত করে, পারিবারিক সহিংসতার (ওচঠ) প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে ৮০ শতাংশ থেকে ৮৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বর্তমান লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার পরিস্থিতি ও পরিধি বোঝার জন্য কেয়ার বাংলাদেশ, জাগো ফাউন্ডেশন ও আইসিডিডিআর,বি মিলে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণার প্রাথমিক ফল যাচাই করার জন্য কেয়ার বাংলাদেশ নিজেদের অফিসে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। এ কর্মশালায় জাতীয় পর্যায়ের নারীনেত্রীসহ বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানিয়েছেন।
এ গবেষণায় বাংলাদেশের সাতটি বিভাগে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ১ হাজার ৭১৫ জন নারীর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, অংশগ্রহণকারীদের ৯৫ শতাংশ বিবাহিত ছিলেন এবং তাদের গড় বয়স ছিল ২৯ বছর। গবেষণার ফল থেকে দেখা যায়, বর্তমানে ২৫-৩৪ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ এবং ৪৫-৫৪ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। অপেক্ষাকৃত কমবয়সি নারীদের ওপর শারীরিক সহিংসতার উচ্চ প্রবণতার পেছনে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। অন্যদিকে জানা গেছে, কমবয়সি নারীরা যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। এর পেছনে তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় কারণ।
এ পরিসংখ্যানগুলো সমাজে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রকৃতি ও মাত্রা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেয় এবং এটি প্রতিরোধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরে। এ অবস্থায় একটি ইতিবাচক চিত্র দেখতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিপক্ষে জোরদার অবস্থান জানাতে হবে। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ খুঁজে বের করে তা নির্মূল করার জন্য বিনিয়োগ জরুরি।
কেয়ার বাংলাদেশ নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল করতে বাংলাদেশে প্রায় ৩ দশকেরও বেশি কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেক বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম পন্থাগুলো হলো-নারী ও কন্যাশিশুর অংশগ্রহণে সামাজিক বিশ্লেষণ, কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন, নারী ও কন্যাশিশুসহ সব লিঙ্গভিত্তিক মানুষের মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রুখে দেওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্বদান। পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সব বিষয়ে নারী এবং কন্যাশিশুদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নারীকে বিভিন্ন নামে বিশেষায়িত করে ‘ট্যাগিং’ এবং অপবাদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা পরিবার থেকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নির্মূল একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত একটি সমাজ গড়তে হলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মধ্যে যে গতিশীলতা ও অগ্রগতি করেছে, তা ধরে রাখলে ভবিষ্যতে সহিংসতামুক্ত একটি সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : ডিরেক্টর, উইমেন অ্যান্ড ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্ট কেয়ার বাংলাদেশ