দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলার অপরাজিত মেয়েরা
ওমর ফারুক রুবেল, কাঠমান্ডু (নেপাল) থেকে ফিরে
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০২২ ও ২০২৪। দুবছরের ফারাক। একই মঞ্চ-সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। একই ভেন্যু-কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়াম। অবাক হলেও সত্যি, শিরোপা জয়ের পথে একই প্রতিপক্ষ সাবিনাদের। গ্রুপ পর্বে ভারতকে (৩-১), সেমিফাইনালে ভুটানকে বিধ্বস্ত করা (৭-১) এবং ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে (২-১) হারিয়ে ফের দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়ে শিরোপার স্বাদ আস্বাদন। দুবছরের এ মাথা-ও মাথা। দেশে ফিরে ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা। এ সবই অদম্য আর অপরাজেয় বাংলার বাঘিনী মেয়েদের সাফল্যগাথার ইতিহাস।
গতি আর দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশের মেয়ে ফুটবলাররা। দুবছর আগে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত সাবিনারা অনায়াসে প্রথমবার অর্জন করেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা তকমা। এবার ভঙ্গুর এক দল নিয়েও নিজেদের ঐক্য আর উদ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো এ শিরোপা দেশে নিয়ে ফিরেছেন সাবিনা খাতুনরা। যাওয়ার আগে অনেকে যে দলটিকে বড়জোর সেমিফাইনালিস্ট ধরে রেখেছিল, সে দলটিই নিজেদের ঐক্যের কারণে আজও দক্ষিণ এশিয়ার মুকুট ধরে রেখেছে। তবে এবারের শিরোপা যাত্রাটা অতটা মসৃণ ছিল না সাবিনাদের। চারটি ম্যাচ বিশ্লেষণই তার প্রমাণ।
পাকিস্তানের বিপক্ষে অচেনা সাবিনারা
সাত দেশকে দুটি গ্রুপে বিভক্ত করে এবারে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ গ্রুপে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও ভারত। ২০ অক্টোবর দশরথের রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামেন সাবিনা খাতুন, রূপনা চাকমারা। ম্যাচের ৩২ মিনিটে এগিয়ে যায় পাকিস্তান। এগিয়ে থাকার অন্যতম কারণ তাদের শারীরিক উচ্চতা ও খেলার গতি; যা সাবিনা, সানজিদাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। নাদিয়া খান, আনমল হীরাদের উচ্চতা ও গতির সঙ্গে শুরুর দিকে কুলিয়ে উঠতে পারেননি শামসুন্নাহাররা। পাকিস্তান দলে খেলা মেয়েদের মধ্যে ছয়জন রয়েছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বেড়ে উঠেছেন। অন্যদিকে ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন ও গতির রানি ফরোয়ার্ড সিরাত জাহানের অভাব প্রকটভাবে অনুভূত হয় লাল-সবুজ শিবিরে। রক্ষণ এতটাই আলগা ছিল, গোল পেতে কোনো কষ্ট হয়নি পাকিস্তানের। সিরাত জাহানের মতো ফরোয়ার্ডের অভাবে বারবার চেষ্টা করেও গোল ফিনিশিং করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে পুরো ম্যাচে ঋতুপর্ণা চাকমার খেলা ছিল চোখে পড়ার মতো। যার ফলে ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠে তার হাতেই। যদিও ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে গোল করে পরাজয় এড়িয়ে দলকে অন্তত এক পয়েন্ট এনে দেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। আগের আসরে যে পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল বাংলাদেশ, এবারের আসরে সেই দলটির বিপক্ষে অচেনাই মনে হয়েছে সাবিনাদের।
একতাই বল, ভারতের বিপক্ষে জয়ে তাই প্রমাণিত
পাকিস্তান ম্যাচের পর নারী ফুটবল দলের মধ্যে সিনিয়র ও জুনিয়র বিভেদ মিডিয়াতে চাউর হয়। মনিকা চাকমার একটি কথাই (কোচ সিনিয়রদের দেখতে পারেন না) বিভেদের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। দুদিন এ নিয়ে মিডিয়াতে সমালোচনা কম হয়নি। অনেকেই ভেবেছেন, হয়তো বিভেদ প্রকট হয়ে উঠবে মাঠে। ভারতের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিতে হবে বাংলাদেশকে। যদিও সেমিফাইনালে যেতে সাবিনাদের প্রয়োজন ছিল ভারতের বিপক্ষে নিদেনপক্ষে ড্র। এমনকি ২-০ গোলে হারলেও শেষ চারে যাওয়া নিশ্চিত ছিল। সমীকরণ এমন ছিল, ভারতের কাছে ২-০ গোলে হারলে বা ড্র করলে এ গ্রুপে রানার্সআপ দল হিসাবে সেমিফাইনালে খেলবে বাংলাদেশ। তবে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে সাবিনাদের মোকাবিলা করতে হতো বি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন স্বাগতিক নেপালকে; যা খুবই কঠিন হতো। কারণ নেপালের ফরোয়ার্ডে সাবিত্রা ভান্ডারি ও রেখা পাউডেল জুটি খুবই ভয়ংকর ছিল। বিষয়টি ভেবে আগে থেকেই গা ছমছম করছিল। মনের মণিকোঠায় খচখচ করছিল।
কিন্তু অবাক হলেও সত্যি, বাইরের কোনো সমালোচনাই যেন তাদের খেলায় দেখা যায়নি। কীসের কম ব্যবধানে হার, কীসের ড্র। এক ধরনের আগুন ঝরানো ম্যাচ খেলে ভারতকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ভারতকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হিসাবেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেন সাবিনারা। এক ম্যাচেই যেন সব আলোচনা-সমালোচনা ছুড়ে ফেলেন তহুরা, আফঈদা খাতুনরা। বাংলাদেশের তহুরা খাতুন দুটি ও আফঈদা খন্দকার একটি গোল করেন। এ দিন ম্যাচের শুরু থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশকেই দেখা গেল। ওই ম্যাচে যেন ঐক্যের এক বাংলাদেশকেই দেখল দর্শক।
ভুটানকে বিধ্বস্ত করে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ
আগের ম্যাচেই বোঝা গিয়েছিল স্বমূর্তিতে ফিরেছেন বাংলার বাঘিনীরা। ভুটানের বিপক্ষে দেখা গেল ঐক্য আর গতির রানি সাবিনাদের। ভুটানকে ৭-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফের ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। আগের আসরেও এ দলটিকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল সাবিনারা। বাংলাদেশের কাছে আরও একবার বিধ্বস্ত হয়ে বিদায় নেয় ‘উত্থিত’ ভুটান। আগের আসর থেকে এক গোল কম হজম করে তারা। এমনকি একটি গোলও তারা দেয় লাল-সবুজের জালে। ম্যাচে তহুরা খাতুন হাটট্রিক করেন। কাঠমান্ডুতে অনেক ঝড় বয়ে যায় সাবিনাদের ওপর দিয়ে। অন্তঃকলহ আর গৃহদাহে ক্ষতবিক্ষত লাল-সবুজের শিবির ফের ঘুরে দাঁড়ায়। শতভাগ উজাড় করে খেলেন তারা। গত আসরে ভুটানের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। এবার তার জায়গা নেন তহুরা খাতুন। ভুটানের রক্ষণে সারাক্ষণ ত্রাস ছড়িয়েছেন ময়মনসিংহের ‘মেসি’খ্যাত তহুরা খাতুন। সিনিয়র সাফে এটাই তহুরার প্রথম হ্যাটট্রিক। জাতীয় ও বয়সভিত্তিক মিলিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে তহুরার গোল ৫৪টি। এ ছাড়া ম্যাচে জোড়া গোল করেন সাবিনা খাতুন। একটি করে গোল করেন ঋতুপর্ণা চাকমা ও শিউলি আজিম। ভুটানের একমাত্র গোলটি দেকি লাজমের।
অদম্য এক বাংলাদেশকেই চেনালেন সাবিনারা
নেপালের শক্তি ছিলেন ফ্রান্স লিগে খেলা সাবিত্রা ভান্ডারি। ফরোয়ার্ডের অকুতোভয় এক নারী ফুটবলার এ সাবিত্রা। মাঠে তার পারফরম্যান্স তাক লাগাতে বাধ্য। গত আসরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় খেলতে পারেননি। এবার শিরোপা খরা ঘোচাতে সুদূর ফ্রান্স থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল সাবিত্রাকে। তার রণকৌশলেই ভারতের বিপক্ষে হারা ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ে নেপাল। তাই ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে তিনিই ছিলেন নেপালের ট্রাম্পকার্ড; কিন্তু ভিন্ন রণকৌশল নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশ। সাবিত্রাকে আটকে রেখে নিজেদের ফরোয়ার্ডদের গোল করার বার্তা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ কোচ পিটার জেমস বাটলার। সেই কৌশলই কাজে দেয় সাবিনাদের। অদম্য আর সাহসিকতার এক নিদর্শন হয়ে ওঠেন তারা। ম্যাচে মনিকা ও ঋতুপর্ণা চাকমার দুই গোলেই শেষ পর্যন্ত সাবিত্রা ভান্ডারিদের হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশ। প্রায় ১৬ হাজার নেপালি দর্শকদের চুপ করিয়ে দিতে কোনো জুড়ি ছিল না সাবিনাদের। ফলে ছয়বার ফাইনাল খেলে একবারও ট্রফি পেল না হিমালয়কন্যারা।
জীবনবাজি রেখে খেলেই শিরোপা জিতেছে মেয়েরা
পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি বাদ দিলে গ্রুপে ভারত ও সেমিফাইনালে ভুটানকে উড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের ১৬ হাজার দর্শক ও সাবিত্রা ভান্ডারিদের বিপক্ষে লড়াইয়ের আগে দারুণ এক পণ করেছিলেন বাংলার বাঘিনীরা। কী সেই পণ? শুনুন দলের ‘মেসি’খ্যাত তহুরা খাতুনের মুখ থেকেই; ‘ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন রাতে আমরা একসঙ্গে খাবার খেতে বসেছিলাম। তখনই পণ করেছিলাম, শিরোপা জিততে আমাদের আরেকটি ম্যাচেই জয় প্রয়োজন। তাই জীবনবাজি রেখে খেলব। নতুন করে জেগে ওঠা দেশকে নতুন একটি ট্রফি এনে দিতে চেয়েছিলাম। এটি আমাদের প্রয়োজন ছিল। আমরা দেশকে উপহার দিয়েছি নতুন একটি ট্রফি। ‘নতুন বাংলাদেশকে নতুন শিরোপা উপহার দিয়েছি’,-কথাটি বলে শিরোপা উৎসবকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
সাফের সেরা বাংলাদেশই
এবারের সাফে ছয়টি পুরস্কারের তিনটিই জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমত চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। দ্বিতীয়ত গোলপোস্টের নিচে অতন্দ্র প্রহরী রূপনা চাকমা জিতেছেন সেরা গোলকিপারের পুরস্কার। প্রতিপক্ষের জালে ১৩ গোল দিলেও রূপনা হজম করেছেন মাত্র চারটি। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন উইঙ্গার ঋতুপর্ণা চাকমা। পুরো টুর্নামেন্টে যিনি দলকে উজ্জীবিত রেখেছেন। গোল করিয়েছেন এবং নিজেও করেছেন। তাই নির্বাচকরা ঋতুপর্ণা ছাড়া আর কাউকেই সেরা খেলোয়াড় হিসাবে নির্বাচিত করতে পারেননি।
ঋতুপর্ণা, রূপনারা নাম লেখালেন ইতিহাসে
এমনিতে লাজুক স্বভাবের ঋতুপর্ণা চাকমা। কিন্তু সেই লাজুক মেয়েটিই মাঠে একেবারে অন্য রকম। পায়ের কাজ, গতি, স্ট্যামিনা-মনেই হয় না এ ঋতুই মাঠের বাইরে একেবারে চুপচাপ, সব সময় লেগে আছে লাজুক হাসি। অথচ কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে ঋতুপর্ণা কী অসাধারণ খেলাটাই না খেললেন। তারই দুর্দান্ত এক গোলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফের শ্রেষ্ঠত্ব ঘরে তোলে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের সেরা গোলকিপার রূপনা টুর্নামেন্টে হজম করেছেন মাত্র ৪ গোল। ফাইনালে কয়েকবার বল তার হাত ফসকালেও তা দলের জন্য বিপদ হয়ে আসেনি। আবার দারুণ কিছু গোলও বাঁচিয়েছেন রূপনা। গতবারও প্রতিযোগিতার সেরা গোলকিপার হয়েছিলেন। এবারও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন তিনি। অন্যদিকে গত আসরে অধিনায়ক সেরা খেলোয়াড়ের মুকুট জিতলেও এবার জিতেছেন ঋতুপর্ণা চাকমা। দুজনই ইতিহাসের মণিকোঠরে ঢুকে গেলেন।