হাতে হাতে বই পৌঁছে দেন তিনি
শওকত আলী রতন
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নারী ও সমাজকে আলোকিত করতে এভাবেই বই হাতে মাইলের পর মাইল ছুটে চলেন মাধুরী বণিক
নিজের চলার জন্য প্রয়োজনীয় সম্বল না থাকলেও অন্যের অধিকার আদায়ে ও সুযোগ সুবিধা নিয়ে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে যে নেই তা নয়। আর সেই ভাবনা থেকে যারা সাধ আর সাধ্যের মধ্যে থেকে চেষ্টা করেন অন্যের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে-তারাই প্রকৃত মানুষ। এমনই একজন মানুষ মাধুরী বণিক। যিনি মানুষের জ্ঞানকে প্রসারিত করতে বেছে নিয়েছেন বই। বই হোক প্রকৃত বন্ধু, বই জ্ঞানের আলো-এ মূল মন্ত্র বুকে ধারণ করে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেন মাধুরী বণিক।
তার জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার পানালিয়া গ্রামে। ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার কাজই যেন ষাটোর্ধ্ব এ নারীর জীবনের ব্রত। পড়ুয়ারা মনে করেন মাধুরী বণিকের মতো মানুষ থাকলে সমাজ থেকে গোঁড়ামি আর কুসংস্কার দূর করা সম্ভব।
আজ থেকে ১৮ বছর আগে অর্থাৎ ২০০২ সালে ‘জীবনের জন্য বই পড়া’ এ ভাবনা থেকে মাত্র ৫টি বই নিয়ে মাধুরী বণিক ব্যক্তি উদ্যোগে একটি পাঠাগারের শুভ সূচনা করেছিলেন। তখন তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের উদ্ধুদ্ধ করতে তাদের হাতে হাতে তুলে দিতেন বই। নারীরা তার কর্মস্পৃহা দেখে অভিভূত হন, আর তাদের অনুরোধেই ‘জীবনের জন্য পড়া’ এ নাম থেকে সরে এসে তার বই পড়া কর্মসূচির নাম দেন ‘মায়েদের জন্য বই পড়া’।
মাধুরীও বিশ্বাস করেন, মায়েরা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হলে সন্তানরাও একই সঙ্গে আলোকিত হয়ে উঠবে। এতে আলোকিত হবে সমাজ এবং রাষ্ট্র। সেই থেকে এ নামেই চলছে পাঠাগারের কার্যক্রম। হাতেগোনা মাত্র ৫টি বই দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে তার সংগ্রহে রয়েছে ২০০টির বেশি বই। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, গবেষণাধর্মী ও শিশুদের পাঠ উপযোগী বিভিন্ন বই। তবে পাঠক অনুযায়ী এ বইয়ের সংখ্যাকে অপ্রতুল মনে করছেন তিনি।
মাধুরী বণিকের পাঠক রয়েছে উপজেলার সমসাবাদ, পানালিয়া, কাসেমপুর, নবাবগঞ্জ ও সুরগঞ্জ এলাকায়। সপ্তাহে তিন দিন তিনি পাঠকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বই দিয়ে আসেন এবং আগের দেওয়া বই ফেরত নিয়ে আসেন। আর এ জন্য কোনো ফি গুনতে হয় না পাঠককে।
ব্যক্তিগত জীবনে মাধুরী বণিক অবিবাহিত একজন নারী। অন্যের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে করা হয়নি ঘর-সংসার। জীর্ণশীর্ণ শরীরে বই হাতে ছুটে চলেন এপাড়া থেকে ওপাড়া। নিজের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। তিনি স্বপ্ন দেখেন, তার পাঠাগারটি একটি জাতীয় পাঠাগারে পরিণত হবে একদিন। সেখান থেকেই প্রতিদিন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ প্রয়োজনীয় বই নিয়ে এবং সেসব বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। সেই স্বপ্নেই কাটে তার দিনরাত।
মাধুরী বণিকের সংগ্রহশালায় যে বই রয়েছে সেগুলো দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে বই দেওয়া সম্ভব নয়।
মাধুরী বণিক বলেন, ‘বইয়ের স্বল্পতার জন্য রুটিন করে বই দিয়ে থাকি। একজনের কাছ থেকে বই উঠিয়ে এনে অন্যজনকে সেই বই দিতে হয়। বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো গেলে পাঠাগারটি একটি আদর্শ পাঠাগারে পরিণত হবে আমি মনে করি।’
তিনি আরও জানান, ‘বই রাখার জন্য আধুনিক কোনো আসবাবপত্র নেই আমার।’
এ বিষয়ে সমসাবা এলাকার বাসিন্দা ও চিকিৎসক ডা. মাসুদ জানান, ‘মাধুরী বণিক যে কাজটি নিরসলভাবে করে যাচ্ছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়া একেবারে সহজ কোনো কাজ নয়, আর সেটিই তিনি একজন নারী হয়ে করে যাচ্ছেন। রোদ বৃষ্টি উপক্ষো করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিচ্ছেন। এ কাজ মানুষ এবং সমাজকে আলোকিত করছে।’
এ ব্যাপারে পানালিয়া এলাকার একজন নিয়মিত পাঠক লিপি আক্তার বলেন, ‘মাধুরী খালা সমাজের অবহেলিত নারীদের পাশে দাঁড়ান, এটা তার সবচেয়ে বড় গুণ। পাশাপাশি সমাজে নারীদের উন্নয়নে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড করে থাকেন। আমি মাধুরী খালার নিয়মিত পাঠক। শুরু থেকে এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বই দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ জন্য কখনো কোনো পয়সা নেন না তিনি।’
মাধুরী বণিক জানান, সমাজে নীতি-নৈতিকতার অভাব। দিন দিন সমাজ অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। এ অবক্ষয় রোধে নারীদের ভূমিকা রয়েছে। তাই আমি মায়েদের বই পড়ানোর মাধ্যমে প্রথমে নারীদের মধ্য থেকে যেসব অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার রয়েছে তা দূরীকরণে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে বইয়ের স্বল্পতা রয়েছে, এটা কাটিয়ে উঠতে পারলে আরও একাধিক গ্রামকে সংযুক্ত করে বইয়ের পাঠক আরও বাড়ানো সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।