ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল। পাশাপাশি তিনি শামসুন নাহার হলের প্রভোস্টের দায়িত্বও পালন করছেন। লিখেছেন-রীতা ভৌমিক। ছবি তুলেছেন মনির আহমেদ
নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ড. লাফিফা জামাল। রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার সূত্র ধরেই তিনি স্বপ্ন দেখেন এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি বেশি গবেষণায় সম্পৃক্ত হবেন। তারা তাদের গবেষণার ফল দেশের কাজে লাগাবেন। এ ছাড়া তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ রোবটিক অলিম্পিয়াড আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থান পেয়েছে। আয়োজক হিসাবে এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ রোবটিক রোবট অলিম্পিয়াডের ৮ প্রতিযোগীকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ৭ থেকে ১২ বছরে জুনিয়র এবং ১৩ থেকে ১৮ বছরে চ্যালেঞ্জ গ্রুপ। তাদের নিয়ে একটি ইভেন্টের আয়োজনও করেন তিনি। এ প্রতিযোগিতায় যারা ভালো ফলাফল করেছে তাদের নিয়ে একটি ক্যাম্প করেন। ক্যাম্পের ফলাফল এবং অন্যান্য দিকগুলো যাচাই করে তাদের আন্তর্জাতিক রোবটিক অলিম্পিয়াডের জন্য মনোনীত করা হয়। ২০১৮ সালে ২০তম আন্তর্জাতিক রোবটিক অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ প্রথম প্রতিনিধিত্ব করে ফিলিপাইনের ম্যানিলাতে। আট প্রতিযোগীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি এবং একজন বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের কোঅর্ডিনেটর। এই প্রতিযোগিতায় জুনিয়র থেকে দেশের জন্য একটি স্বর্ণপদক আসে। এরপর তার নেতৃত্বে ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে ১৫ প্রতিযোগী অংশ নেয়। সেবার বাংলাদেশ দল একটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্যপদক অর্জন করে। কোভিড ১৯-এর কারণে অনলাইনে ২০২০ এবং ২০২১ সালে প্রতিযোগীরা অংশ নেয়। এ প্রসঙ্গে ড. লাফিফা জামাল বলেন, রোবটিক্স বিভাগের শিক্ষক হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমাদের শিশুদেরও এ বিষয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। ওদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। একটি টিম ওয়ার্কিং হিসাবে আমরা এ কাজটি করছি। রোবটিক্সে যুক্ত শিশুরা দিনে দিনে ভালো করছে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওরা ওদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সেরাটা দেওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি করছে। রোবটিক্সে ছেলেশিশুর পাশাপাশি মেয়েশিশুর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রথম প্রতিযোগিতায় ৮ জনের মধ্যে ২ জন মেয়ে ছিল। দ্বিতীয়বার ১৫ জনের মধ্যে ৫ জন মেয়ে ছিল। তৃতীয়বার ১৯ জনে ৬ জন মেয়ে ছিল এবং চতুর্থবার ১৬ জনে ৮ জন মেয়ে ছিল। এই প্রতিযোগিতায় মেয়েরা নিয়মিত স্বর্ণপদক পাচ্ছে। ড. লাফিফা জামাল বেড়ে উঠেছেন এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে। নারায়ণগঞ্জের জামতলায় কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। মাত্র ১১ মাস বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান। বাবা হোসেন জামাল ছিলেন ব্যবসায়ী। মা মীনা হোসেন গৃহিণী। একমাত্র কন্যাকে বুকে আঁকড়ে ধরে তার মা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। মা-দাদা-দাদি-কাকা-ফুপুদের আদর-যত্ন-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠেন তিনি। তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরি স্কুলে। এরপর নারায়ণগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে এসএসসি, ১৯৯৪ সালে ভিকারুননিসা নূন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার প্রতি তার ঝোঁক ছিল বেশি। এরই একটি শাখা ইলেকট্রনিক্স মেকানিক্যাল। তিনি স্নাতক ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সে। এ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে তিনি পিএইচডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘রিভারসিবল লজিক’। এরপর শুরু হয় তার কর্মজীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চেয়ারপারসন হিসাবে যোগ দেন অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল। বর্তমানে তিনি শামসুন নাহার হলের প্রভোস্টের দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও তিনি।
তার এই এগিয়ে চলার প্রথম সাথি মা। এ প্রসঙ্গে ড. লাফিফা জামাল বলেন, আমার জীবনের এই পথচলার প্রায় সবটুকু অবদান মায়ের। কারণ যে বয়সে তিনি তার স্বামীকে হারিয়েছেন, তিনি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছেন। মায়ের স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা করেছি। মা যেন সব সময় ভালো থাকেন। সুস্থ থাকেন। এ ছাড়া যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠায় সবাইকে নিয়ে চলার শিক্ষাও পেয়েছি। যা আমাকে একজন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে, এক মেয়ের মা। ছেলে শ্রেষ্ঠ এ লেভেলে এবং মেয়ে শ্রেয়সী নবম শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী নওরোজ রহমানও তাকে সব কাজে সহযোগিতা করেন। কোনো কাজেই পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি তিনি। সব সময়ই স্বপ্নপূরণে পরিবারের সদস্যদের সহায়তা পেয়েছেন। সহপাঠীরাও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কর্মক্ষেত্রেও সহকর্মীরা সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখেন। তার মতে, নিজেকে স্বপ্ন দেখতে হবে। শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না। স্বপ্ন পূরণে কাজ করতে হবে। মেধা, পরিশ্রম এবং যোগ্যতার মধ্য দিয়ে মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে। একজন প্রভোস্ট হিসাবে যদি দেখি, তাহলে বলব, বিভিন্ন জেলার মেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। একই রকম পরিবেশ থেকে না আশায় তাদের মধ্যে আচরণের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য এক। তারা লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। দেখতে গেলে এটি একটি ইতিবাচক দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক। সেসঙ্গে মেয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করছে। এখন ডিনস অ্যাওয়ার্ড পাওয়া মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। একজন প্রভোস্ট হিসাবে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও হলের মেয়েদের ভালো পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করি। কোনো সমস্যা হলে তা নিরসন করার চেষ্টা করি।