গল্প
যে আছে মম গভীর প্রাণে
আমাদের জ্যাঠা ইমারত হোসেনের আপাদমস্তক ভেজা, তিনি কাঁপছেন। কিছুক্ষণ আগে আব্বা তাকে গভীর পানি থেকে টেনে তুলেছেন। এ যাত্রায় জ্যাঠা ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেছেন। কারও বুঝতে দেরি হলো না যে, তিনি ভয় পেয়েছেন। সকালের প্রাতরাশ সেরে দুই ভাই গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। মাঝারি গভীর পানি নিয়ে কলকলিয়ে বয়ে যায় হুরাসাগর। পানির কলকল ধ্বনিটা বাজনার মতো, বহুক্ষণ কানে বাজতে থাকে। নদীর একপাশে ছোট ছোট মায়াময় গ্রামগুলো, অপর পাশে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। সাদা সাদা বক পাখিগুলো দলবেঁধে ওড়াউড়ি করছে বিস্মৃত সবুজ মাঠে। কখনো চারাগাছগুলোর আবডালে তারা এমনভাবে অবস্থান নেয় যেন জরুরি সভা ডেকেছে। রাখালের গলার সুর ধানখেতের আইল ধরে বহুদূর চলে যায়। পাশেই বয়ে চলে হুরাসাগর।
ভরা ভাদর মাস। খালবিল পানিতে থই থই করছে। নদীতে নিরাক পড়েছে। এ সময় ভালো মাছ ধরা পড়ে। হুরাসাগরের কৃপা সবার দুহাত ভরিয়ে দেয়। চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, সরপুঁটি, কালিবাউশ, শোল, গজার এসব অজস্র দানে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করে অন্নদাত্রী হুরাসাগর।
জ্যাঠা ইমারত হোসেন এবং আমাদের আব্বা মোহাম্মদ আলী গিয়েছিলেন নদীতে মাছ ধরবেন বলে। শান্ত হুরাসাগর বুক পেতে দিলে জুতি দিয়ে মাছ শিকারে উদ্যত হলেন আব্বা আর আমার জ্যাঠা ইমারত হোসেন। (জুতি হলো একটি বিশেষ ধরনের বড় কোচ যা বড় মাছ শিকারে ব্যবহার করা হয়।) আচমকাই বড় মাছের নড়াচড়া টের পেয়ে জ্যাঠা তার হাতের জুতি সজোরে মাছের দিকে ছুড়ে মারলেন। জুতির শেষাংশে লাগানো দড়ি জ্যাঠা ইমারত হোসেনের হাতে বাঁধা যাতে মাছ জুতি নিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু মাছটি বড় থাকায় মাছের টানে জ্যাঠা নৌকা থেকে জলে পড়ে গেলেন। প্রকাণ্ড এক বোয়াল মাছ সব শক্তি দিয়ে আমাদের জ্যাঠাকে পানির তলায় নিয়ে যেতে থাকে। পরক্ষণে জ্যাঠা এতটাই তলিয়ে গেলেন যে, এক হাতই শুধু পানির ওপরে ভেসে রইল। এমন সময় আব্বা জ্যাঠার হাতের সঙ্গে বাঁধা জুতির দড়ি খুলে দিলেন আর জ্যাঠাকে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সময় উদ্ধার করলেন।
দুই ভাই এ যাত্রায় বেঁচে শূন্য হাতে ঘরে ফিরলেন। উঠোন পেরিয়ে আব্বার হাঁকডাক শুনে বাড়ির ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এলো। আমাদের জ্যাঠা ইমারত হোসেন ততক্ষণে থরথর করে কাঁপছেন। শীতে না ভয়ে নাকি ক্রোধে তা বুঝা গেল না।
হুরাসাগর নদীর কোলঘেঁষে আমাদের গ্রাম। গ্রামের নাম ভুলবাকুটিয়া। গ্রামের ঠিক মাঝখানেই মসজিদ লাগোয়া বাড়িটি আমাদের দাদার পিতা আব্দুল ফকিরের নামে লোকে চিনত ফকির বাড়ি বলে। ছয়টি বড় বড় করোগেটেড টিনের ঘরে বিয়াল্লিশ জনের একান্নবর্তী পরিবার আমাদের।
বারো মাস বাড়ির তিনটি আঙিনা ফুল ফসলে ভরে থাকে। উঠোনের কোণে পুঁইশাকের মাচা, কলমির ঝাড়, বতুয়ার ঝোপ পেরিয়ে দৃষ্টি পড়ে বাড়ির চালে তরতরিয়ে বাড়তে থাকা চালকুমড়া লতাটার দিকে। উঠানের দুই সীমানায় দুটো উঁচু তালগাছ দূর থেকে ফকির বাড়ির গল্প বলে যায়।
হেমন্তের হিম হিম বাতাসে ভুলবাকুটিয়া গ্রামে আমার সুরেলা শৈশব কেটে যায়। মায়ের কড়া শাসন উপেক্ষা করে এপাড়া ওপাড়াজুড়ে সারা দিনমান মার্বেল, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবল, ডাঙ্গুলি খেলা চলতে থাকে। দু-চার টাকা টিফিনের খরচ জমিয়ে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়াও বাদ ছিল না। বাদ পড়ত না সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে স্কুল পালানোর অপরাধে মায়ের হাতে সজোরে বেত খাওয়া। আজো নিজেকে খুঁজে বেড়াই শৈশবের সেই দূরন্ত দিনগুলোর অমূল্য স্মৃতিতে।
ধরিত্রীর চিরায়ত নিয়মে দিবারাত্রি খেলা করে। জীবনাকাশের অগণিত নক্ষত্রের অনন্ত আলোয় কখনোবা কেটে যায় নিয়তির ঘোর অন্ধকার। ফকির বাড়ির সম্পর্কগুলো আরও নিবিড় হয়ে ধরা দেয় সম্পর্কের কাছে। বয়ে চলে সেই একান্নবর্তী পরিবারের দিনরাত্রি, হুরাসাগরের তীরঘেঁষে ফকির বাড়ির প্রশস্ত আঙিনায়।
একদিন সকালবেলা একটি ছোট বাচ্চাসহ একজন মাঝ বয়সি অপরিচিতা আমাদের দরজায় এসে আমার দাদির খোঁজ করতে লাগলেন ।
আমাদের দাদি জসিরন। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। সব সময়ই সাদা শাড়ি পরে থাকতেন। ওই বয়সেও দৃষ্টিশক্তি এতটাই প্রখর ছিল যে, চোখে চশমার প্রয়োজন হয়নি কখনো। তুষারের মতো সাদা শুভ্র চুলে দাদিকে দেখতে অবিকল কোনো রূপকথার গল্প বলা বুড়ির মতো লাগত। যদিও দাদি স্বল্প কিন্তু তীক্ষ্ণভাষী ছিলেন। মুখের ওপর অকপটে অপ্রিয় সত্য বলা ছিল তার চিরায়ত স্বভাব। দুর্লভ শ্লোক বলতেন নানা রকম। দাদির মুখের সেই বচন, শ্লোক শুনার জন্য আমরা ভাইবোনরা মুখিয়ে থাকতাম। পরে দাদি জসিরনকে নিয়েও অনেক শ্লোক বুনেছিল লোকে। আমাদের জ্যাঠা ইমারত হোসেনের বড় মেয়ে লক্ষ্মীবু শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইওর (বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসা) এলে দাদির সঙ্গে ঘুমানোর জন্য অস্থির হতো শুধু দাদির মুখে শ্লোক শোনার আশায়।
আমাদের লক্ষ্মীবু আদতেই বড় ভালো মেয়ে। ভাইবোন বলতে অন্তঃপ্রাণ ছিল। শুনেছি, তার যেদিন জন্ম হলো সেদিন আমার দাদার গোয়ালঘরে একসঙ্গে তিনটি গাভি বাছুর প্রসব করল, আমার দাদি জসিরন তাই নাতনির প্রসন্ন ভাগ্য দেখে তার নাম রাখলেন লক্ষ্মী। দাদির আঁচলে আদরের আড়াল খুঁজে খুঁজে লক্ষ্মীবু বড় হয়। এক সময় অন্য গ্রামে তার বিয়ে হয়ে যায়। তবে প্রায়ই দাদির টানে লক্ষ্মীবু দূর গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে ছুটে আসত। আর আমাদের দাদিও তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতেন। নাইওর আসার পর বয়ামে ভরা নাড়ু, খোরমা, বিভিন্ন রকমের আচার লক্ষ্মীবুকে খেতে দিতেন। পরম মমতায় তার চুলে তখনো খোঁপা করে দিতেন আর নানা পদের শ্লোক বলে বুবুকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন আমাদের দাদি জসিরন।
বছর কয়েক আগে আমাদের দাদা আবু তালেব ইহলোক ত্যাগ করলে সংসারের বটবৃক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এ বৃদ্ধা। চাল, ডাল, নুন, তেল, লাকড়ি, কে এলো-গেল, কে খেল কেইবা খেল না, কোন খবরটা রাখেন না সংসারের! আচারের শিশিগুলো রোদে দেওয়া, তাতে সময় সময় গরম সরিষার তেল ঢেলে দেওয়া, নাতিদের জন্য ডালের বড়ি করে কৌটায় ভরে রাখা এসব কাজ তিনি একাই করে যেতেন ভালোবেসে। শ্বশুর প্রয়াত আব্দুল ফকিরের কাছে কবিরাজি বিদ্যা শিখেছিলেন দাদি। দূর পাড়া থেকেও অনেক নারী, শিশুকে ব্যামো সারাবার জন্য দাদির কাছে আসতে দেখেছি। চিকিৎসা করে যে আয় আমাদের দাদি করেছিলেন তা দিয়ে তিনি বিঘাচারেক জমিও কিনেছিলেন।
সে যাই হোক, পরনে রঙিন শাড়ি, মাথায় খানিকটা ঘোমটা টেনে দেওয়া অপরিচিত মহিলাটির হাতে খাবারের একটি বড় পুঁটলি, সঙ্গে সাত আট বছর বয়সি একটি ছেলে। সদর দরজার একদিকে পুঁটলিটা রেখে তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন; মা কোথায় গো খোকা?
কার মা জানতে না চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে আমি তাকে ঘরের দিকে ইঙ্গিত করতেই দাদি জসিরন বেরিয়ে এলেন। ‘কে এলোরে ওখানে? শব্দ পেলাম মনে হয়?’
অপরিচিতা ঘোমটা সরিয়ে দাদিকে সালাম করতে এগিয়ে গেলেই দাদি সস্নেহে বলে উঠলেন, ‘ও মা তুই বউ? কতদিন পর এলি!’ ছেলেটিকে কাছে টেনে দাদি নথ নেড়ে নেড়ে অনেক কথাই বলে তাকে আদর করলেন। বুঝতে পারলাম এ অপরিচিতা আমার দাদির খুব কাছের কেউ।
দাদি এবং অন্য সবার সঙ্গে তারা পরম আদরে দুপুরে আহার করলেন আমাদের বাড়ি। দাদি জসিরনের নির্দেশ মতো আমার মা এবং চাচি অতিথি ভোজের জন্য কয়েক পদ বেশি রান্না করলেন। দাদির কথা মতো সবার জন্য বাড়িয়ে রান্না করার কথা ভোলেন না আমার মা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দাদি কাছে বসিয়ে নানা কথা জানতে চাইলেন। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো।
দাদিকে আবেগাকুল করে দিয়ে পড়ন্ত বিকালে অতিথিরা বিদায় নিলেন সেবারের মতো। পরে দাদি গল্প করলেন আমাদের কাছে, যিনি এসছিলেন তিনি আমাদের পরমাত্মীয়, আমাদের জেঠিমা, তার বড় ব্যাটার বউ।
আমার বড় জ্যাঠা মোঃ আকবর আলী। তিনি আমার দাদির প্রথম পুত্র, যার সঙ্গে আমার আব্বা মোহাম্মদ আলীরও দেখা হয়নি। কারণ, আমাদের আব্বা জ্যাঠার বছর কুড়ি পরে জন্মেছিলেন। সাত বছর বয়সে আমাদের বড় জ্যাঠা আকবর আলী মারা যান। আমার বড় জ্যাঠার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমাদের দাদা এবং দাদি আমার বড় জ্যাঠার সঙ্গে জেঠিমার কোলে কোলে বিয়ে দেন। তিন বছর বয়সি পাত্রীর সঙ্গে পাঁচ বছর বয়সি পাত্রের কোলে কোলে বিয়ে দেওয়ার দুবছর পর আমার বড় জ্যাঠা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার কোলে কোলে বিয়ে করা স্ত্রী নিজ বাপের বাড়িতেই মানুষ হতে থাকে এবং সবার সম্মতিতে বালিকা বয়সে অন্যত্র তার বিয়ে হয়ে যায়।
অবুঝ বয়সে কোলে কোলে বিয়ে করা সেই জেঠিমা এখনো আমার দাদির সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং মাঝে মধ্যেই পিঠা-পায়েস নিয়ে শিশু বয়সের শাশুড়িমাকে দেখতে আসেন। সম্পর্কের এ বিশুদ্ধতা আমাকে বিস্ময়ে ভাসিয়ে দিল। হায়, এ নিদারুণ নিষ্ঠুর জগতে এমনও কী হয়?
এমনি নানাবিধ ঘটনা পরিক্রমায় দিন বয়ে যায়। একান্নবর্তী পরিবারে একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে আরও কিছু বছর অতিবাহিত হয়, এ জগৎ সংসারের পিপাসা একে একে ফুরায়।
এর মধ্যে একদিন লক্ষ করলাম প্রকৃতির মন বিষণ্ন, পাতা ঝরতে শুরু করছে। শীত আসি আসি করছে। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠব। শীত জমে উঠলে মা বলেছে সবাই মিলে নানা বাড়ি বেড়াতে যাব এবার। আনন্দে আমার কয়েকদিন ঘুম হলো না ঠিক করে। অবশেষে দিন পনেরো পর একদিন শুক্রবার আমাদের নানাবাড়ি যাওয়ার দিন ঠিক হলো।
আমার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠা এবং নানার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার আনন্দকে ম্লান করে দিয়ে সেই বৃহস্পতিবার সকালেই আমার জেঠিমা হালিমা খাতুন (যিনি লক্ষ্মীবুর মা) মারা গেলেন। ফকির বাড়ির আকাশ ঘোর অমানিশায় ছেয়ে গেল, উঠোনজুড়ে নেমে এলো শোকের কালো ছায়া।
আব্বা গেছেন শাহজাদপুর বাজারে, সপ্তাহের সদাই কিনবেন বলে। ফিরে এসে দুপুরের নামাজের তাড়া থাকায় সকাল সকাল রওয়ানা করেছেন আব্বা। হুরাসাগরে পানি কমতে শুরু করেছে। নৌকায় বাঘাবাড়ি হয়ে শাহজাদপুর বাজারে যান আব্বা।
উঠোনের রোদে বসবার টুল পেতে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে রোদ মাখছেন আমাদের জ্যাঠা ইমারত হোসেন। কপাল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত, চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। ফর্সা কপালে রোদের কয়েক ফোঁটা পড়ে কপালটা কেমন যেন চিকচিক করছিল। কে জানত, আজ আমার জ্যাঠার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের আরম্ভ হতে যাচ্ছে একটু পরই। ঘরের ভেতরে ধাত্রী কালুর মা এসেছে গতকাল রাত থেকেই। যে কোনো সময় প্রসব বেদনা উঠতে পারে জেঠিমার।
আমাদের জ্যাঠা ইমারত হোসেনের স্ত্রী হালিমা খাতুন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। ডাক্তারি যত্ন বলতে মাস তিনেক পর পর বাজারের হারু কবিরাজের টোটকা। গর্ভধারণের পর একজন নারী যেসব যত্নে অধিকার রাখেন সেসবের সঙ্গে হুরাসাগর তীরের লোকজনের তখনো আলাপ-পরিচয় হয়নি। তাই ফলবতী নারী সংসারের বাটনা বাটা, বাসন মাজা, কুঁজো হয়ে উঠোন ঝাড় দেওয়া কোনো কিছুই করা থেকে বিরত থাকার অলীক স্বপ্ন দেখতে পারে না। সেই একইভাবে শেষ সময়টুকু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না জেঠিমা হালিমা খাতুন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে স্থানীয় বয়স্ক ধাত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।
তৃতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই ধনুকের মতো শরীর বাঁকিয়ে আমার জেঠিমা হালিমা খাতুন জীবনের ওপারে যাত্রা করলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমাদের জ্যাঠার মুখখানায় গভীর বেদনা ফুটে উঠল। পত্নি বিয়োগের কারণেই হয়তোবা এক নিশ্চুপ নীরবতা তাকে গ্রাস করল। পৃথিবীর কোলে আরেকটি নিষ্পাপ শিশুর আগমন তাকে তেমন বেশি উদ্বেলিত করতে পারল না।
একমাত্র কন্যাকে হারিয়ে জেঠিমার মায়ের বিলাপ সমগ্র আকাশে বাতাসে সুর তুলে ধ্বনিত হতে লাগল। মাতৃ বিয়োগে আমাদের লক্ষ্মীবু চুপচাপ দাদিকে জড়িয়ে ধরে রইল যেন দাদির শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে গোপনে সে তার মাকে অনুভব করছিল। অন্তিম সময়ে আমাদের মা শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে কয়েকফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলেন।
আমার বাচ্চাকালের কল্পনা কাতর মন আকুল হয়ে কত কী ভাবতে লাগল। বেশ কয়েকদিন বসতবাড়ির বিষাদের সঙ্গে আমারও মন ভার হয়ে রইল। বারবার মনের কোণে উঁকি দিল একটি প্রশ্ন, খাটিয়ায় করে জেঠিমাকে কবরখানায় কেন নিয়ে যাওয়া হলো? তার শিশুপুত্র কেন তার সঙ্গে গেল না। আমরা তো মায়ের সঙ্গে নানা বাড়ি যাই, হাটের দিনে গঞ্জে যাই কিছু কিনতে। তাহলে জেঠিমার শিশু পুত্রটি তার মায়ের সঙ্গে কেন গেল না?
আমাদের জেঠিমা মারা গেছেন-এ বিষয়টি আমাকে বুঝার সুযোগ করে দিয়ে জেঠিমার ছেলেটি দেখতে দেখতে আমার কোমর সমান লম্বা হয়ে গেল। আমি জানি না জেঠিমা যেখানে গেছেন সেখানে তাকে পোয়াতি অবস্থায় বাটনা বাটতে হয় কিনা! তবে আমাদের যৌথ পরিবারে বাটনা বাটার জন্য আরেকজন জেঠিমা আনা হয়েছিল বহুদিন আগেই। অর্থাৎ আমাদের জ্যাঠা ইমারত হোসেন আবার বিয়ে করেছিলেন। কিছুদিন পর তার দ্বিতীয় স্ত্রীও মারা যান। আমাদের বিয়াল্লিশ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবারে তখন নতুন অতিথি আসে।
এভাবেই শীতের শিউলিগুলো গাছের তলায় নেতিয়ে পড়ে আর জন্ম-মৃত্যু, হাসি-কান্নার আড়ালে আমরা বড় হতে থাকি। আমার মনে ঢেউ তোলে আমার শৈশব, কৈশোর, আমার ছোটবেলা, আমার যাপিত জীবন। পালাক্রমে আসে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জড়ো হয় ভুলবাকুটিয়া গ্রামে আমাদের দিনরাত্রি। বুক পকেটে সেসবের অসংখ্য স্মৃতি। কলকলিয়ে বয়ে যায় হুরাসাগর। এ কলকল ধ্বনি যেন কালের নীরব সাক্ষী।