অফিসের গাড়ি বিগড়ে গেছে। কবেনাগাদ ঠিক হবে, বলা যায় না। বিষয়টি নির্ভর করছে পরিবহণ কর্মকর্তার মর্জির ওপর। অফিসে যে সিন্ডিকেট আছে, তার সঙ্গে সে জড়িত। এজন্য কাউকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন মনে করে না। ইচ্ছা হলে অফিসে আসে। ইচ্ছা না হলে আসে না। আমার গাড়ি ঠিক করার ব্যাপারে তার একদমই আগ্রহ নেই। আমি তো আর সিন্ডিকেটের সদস্য নই। এ কারণে আমার গুরুত্ব কম। অগত্যা, এখন মেট্রোরেলই ভরসা।
ভাগ্যিস দ্রুতগামী এই গণপরিবহণ বাসার পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করে। বাসা আর অফিসের দূরত্ব শুধু কমিয়ে দেয়নি, নিয়ে এসেছে একরাশ স্বস্তি। অনেকটা স্বপ্নের মতো মনে হয়। আগে পল্লবী থেকে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিলে কতক্ষণে পৌঁছানো যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। গাড়িতে উঠে বড়সড় একটা উপন্যাস পড়া শুরু করলে প্রায়শই শেষ হয়ে যেত। কখনো কখনো গন্তব্যে পৌঁছতে তিন ঘণ্টারও বেশি লেগেছে। ফেরার সময়ও একই অভিজ্ঞতা হয়। সেই সঙ্গে শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদ।
যাতায়াতেই দিনের বড় একটা অংশ ব্যয় হয়ে যেত। শরীরকে এমনভাবে নিংড়ে নিত, কাজ করার আগ্রহ থাকত না। মেট্রোরেল যেন অনেকটা ম্যাজিকের মতো। এমনই তার গতি, যাতায়াতের সময় বেশিরভাগ সময়ই একটা ছোটগল্প পড়ারও সুযোগ হয় না। আরব্য রজনীর 'আলী বাবা ও চল্লিশ চোর' লোককাহিনীতে গুপ্ত আস্তানায় গিয়ে 'চিচিং ফাঁক' বললে গুহার মুখ খুলে যেত। আবার 'চিচিং বন্ধ' বললে গুহার মুখ বন্ধ হতো। মেট্রোরেল যেন অনেকটা সেই রকম। তাতে উঠতে পারলে আর কোনো দুঃশ্চিন্তা থাকে না। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় জুড়িয়ে যায় শরীর। অফিসেও সময়মতো পৌঁছে যাওয়া যায়।
ঈদের ছুটির কারণে অফিস ঢিলেঢালাভাবে চলায় আজ কিছুটা আগেভাগেই মতিঝিল স্টেশন থেকে প্রতিদিনের মতো মেট্রোরেলে ওঠেছি। ভিড়ভাট্টা নেই। এই স্টেশন থেকে উঠলে বসার সিট পাওয়া সহজ হয়। যদিও সব মিলিয়ে ২৬-২৭ মিনিটের পথ। দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়। বসে বসে মোবাইল ফোনে চোখ বুলাতে থাকলে কখন গন্তব্য এসে যায়, অনেক সময় টেরই পাওয়া যায় না। আজও ফেসবুকে গভীর মনোযোগ থাকায় এর আগে খেয়াল করেনি। ইতোমধ্যে কখন যেন মেট্রোরেল ছেড়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অকস্মাৎ সামনের ডান দিকে তাকালে এক ভদ্র মহিলার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। তার মুখাবয়ব ঝলমলিয়ে উঠলেও মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেন। কোনাকুনিভাবে আমাদের অবস্থান। তিনি একা নন। তার সঙ্গে দুজন ঝলমলে তরুণী। চেহারা-সুরত দেখে মনে হয় ভদ্র মহিলার মেয়ে হতে পারে। তিনজনেরই বেশ পরিপাটি সাজ। আলাদা চাকচিক্য আছে। দুই মেয়েরই পরনে চোখ কাড়ার মতো হলদে পোশাক। চনমনে মেজাজ। সব কিছু কেমন কৌতূহল নিয়ে অবলোকন করতে থাকে। এরা কি পরবাসী নাকি? অনেক দিন পর কি দেশে এসেছে? ভাবগতিক দেখে তেমনই মনে হয়।
ভদ্র মহিলার আকাশ-নীল রঙের পোশাক কেমন একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে। ফেসবুকে দৃষ্টি দিলেও আমার মনটা মোটেও সুস্থির নেই। বারবার ওই দিকে চোখ চলে যায়। আড়চোখে দেখতে থাকি। আমি কি তার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে যাই নাকি অন্য কোনো কারণ ঠিক বুঝতে পারি না। মনের মধ্যে কেমন যেন কুটকুট করতে থাকে। ভদ্র মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হয় কিন্তু ধরতে পারছি না। ইদানীং চেনা মানুষকেও চিনতে সমস্যা হয়। আউলাঝাউলা লেগে যায়। বয়স তো অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। তবে করোনাকালের পর থেকে এটা বেশি বেশি হচ্ছে। প্রতারিত করছে স্মৃতি। এ কারণে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়।
চট করে মাথায় খেলে যায়, সিনথিয়া নয় তো? তেমনই মায়াবী চোখ আর ঠোঁটে মুক্ত ঝরা হাসি লেগে আছে। আগের মতো অবশ্য স্লিম নেই। বয়সের কারণে খানিকটা ভারিক্কি ভাব এসেছে। তাতে অবশ্য ফুটে উঠেছে অন্যরকম এক সৌন্দর্য। তবে বয়সকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সযত্ন একটা প্রয়াস চোখে পড়ে। ফর্সা গালে মেকআপের পরিশীলিত পরিচর্যা। খোলা চুলে লালচে রং। ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন রকম গহনা পরনে। ভদ্র মহিলা যে সিনথিয়া এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। এমন মিল তো অনেকের সঙ্গেই হতে পারে। আর আমি তো অনেক সময় গুলিয়ে ফেলি। অচেনা মানুষকেও কখনো কখনো চেনা মনে হয়। একটা ধাঁধায় পড়ে যাই। হিসাব কখনো মিলছে, কখনো মিলছে না।
হঠাৎ মনে হলো, সিনথিয়ার গ্রিবায় একটা তিল ছিল। ভদ্র মহিলার গলায় সেটা থাকলে আরও নিশ্চিত হওয়া যায়; কিন্তু তার গলা ওড়নায় ঢাকা পড়ায় পুরোপুরিভাবে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া সরাসরি তাকানো না যাওয়ার কারণে তিলের সন্ধান করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, সিনথিয়াই হবে। ভদ্র মহিলা মেয়েদের সঙ্গে কথায় মেতে আছেন। তাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে, আজই প্রথম অনেকটা শখ করে উঠেছেন মেট্রোরেলে।
কী এক কথায় ভদ্র মহিলা হাসিতে ভেঙে পড়লে ওড়নাটা স্থানচ্যুত হয়। এই ফাঁকে চোখ চলে যায় তার গলদেশে। আমার দিকে দুষ্টু দুষ্টু চাহনি দিয়ে মিটমিট করে হাসছে পরিচিত তিলটি। হাসি দেবেই না কেন? আমাকে তো তার অপরিচিত মনে হওয়ার কারণ নেই। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কত স্মৃতি। সব কথা তো আর বলা যায় না। সেই বয়স তো কবেই পেরিয়ে এসেছি।
কোনো এক ঈদের পরের দিন বিকালে বন্ধুদের নিয়ে ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে যাই। সিনথিয়ার সঙ্গে সেখানে দেখা হয়। সেও আসে তার বান্ধবীদের নিয়ে। বেশ হৈহুল্লোড় করতে থাকে। সহজেই নজর কেড়ে নেয়। আর আমরাও মওকা পেয়ে যাই। বয়সটাও তো তখন তেমনই। অপজিট সেক্সের প্রতি সহজাত একটা টান অনুভূত হয়। এখন কী হয় না? দুষ্টুমি আর ফাজলামো করতে করতে আমরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিলেমিশে যাই। ভাগ করে নেই আনন্দফুর্তি।
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ছিল ছায়া ছায়া মায়া মায়া। কত রকম গাছগাছালি। নানান রকম ফুলের সৌরভ। পাখিদের কলতান। সিনথিয়াদের উপস্থিতি ভরিয়ে দেয় রোমান্টিকতাকে। এক সঙ্গে ঘোরাঘুরি, চটপটি-ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়া, ঘাসের মাঠে বসে এলোমেলো আড্ডা, সব মিলিয়ে স্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে। এক সময় কখন যেন চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়? আমরা তখন রীতিমতো স্বপ্নের জগতে উড়ছি। দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে, তার খবর আর কে রাখে?
খবর না রাখলেও কোনো কিছু তো আর থেমে থাকে না।
বলা নেই, কওয়া নেই, ধুমছে বৃষ্টি নামে। আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। সে যে কি বৃষ্টি! যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। কোথাও ছুটে যাওয়ার আগেই কাকভেজা হয়ে যাই। কাছাকাছি কোনো ছাউনি না থাকায় বন্ধুরা সব বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। ঘটনাচক্রে সিনথিয়া আর আমি বিশাল একটা গাছের নিচে আশ্রয় নেই। তবুও অল্প অল্প ভিজতে থাকি। কাছাকাছি কেউ আছে কিনা বোঝার উপায় নেই। বৃষ্টির ঘনত্ব এত বেশি, আশপাশের কিছুই দেখা যায় না।
সেদিন সিনথিয়ার পরনে ছিল উজ্জ্বল নীল রঙের সুতির শাড়ি। মানানসই ব্লাউজ। কপালে টিপ। অসাধারণ লাগছিল; কিন্তু বৃষ্টিতে সব অগোছালো হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ে সে খুবই বিব্রত হয়ে পড়ে। কোনো কিছুই ঠিকমতো সামাল দিতে পারছিল না। বৃষ্টিতে তার সাজগোজ সব ধুয়েমুছে যায়। যদিও ভেজা সিনথিয়াকে আমার কাছে আরও বেশি দুর্দান্ত লাগতে থাকে। তখনই নজরে পড়ে তার গলদেশে থাকা ব্ল্যাক ডায়মন্ডের মতো দ্যুতি ছড়ানো তিলটি। বৃষ্টিতে ভেজা তিলটি আলাদা মাধুর্য ছড়াতে থাকে। তিলটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলে সিনথিয়া জড়োসড়ো হয়ে তা ঢাকার চেষ্টা করে। যদিও বৃথাই সে চেষ্টা।
ঠান্ডায় সিনথিয়া রীতিমতো কাঁপতে থাকে। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমিও মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম না। এমনিতেই আমার ঠাণ্ডার সমস্যা। একটু বৃষ্টি লাগলে খবর হয়ে যায়। আর এখন তো রাঙামাটির শুভলং ঝর্ণার মতো বিপুল জলরাশির বেগ সইতে হচ্ছে। গাছের নিচে গিয়েও পুরোপুরিভাবে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। মজার বিষয়, দুজন একসাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো কথা হচ্ছিল না। আসলে পরিস্থিতি তখন এতটাই জটিল, কথারাও খেই হারিয়ে ফেলে।
এভাবে অনেকক্ষণ চলতে থাকলে সিনথিয়ার জন্য আমার কেন যেন মায়া হতে থাকে। বুকের মধ্যে কেমন কেমন করতে থাকে। বোধকরি কিউপিডের তীরে ধীরে ধীরে বিদ্ধ হতে থাকি। আমার ইচ্ছা করছিল সিনথিয়াকে বুকের মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতায় উষ্ণতায় ভরিয়ে দেই। তা তো আর শোভনীয় নয়। কথা নেই, বার্তা নেই, ক্ষণিকের চেনা একটা মেয়েকে কি স্পর্শ করা যায়? সেটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। মনের চাওয়া মনেই থেকে যায়। কী করা যায়?
কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। বৃষ্টির থামাথামির কোনও লক্ষ্মণ নেই। তখন সিনথিয়াকে বললাম, এখানে একটু অপেক্ষা করেন, দেখি আপনার জন্য কিছু ব্যবস্থা করা যায় কিনা? এই বলে সামনের দিকে এগোতেই সিনথিয়া আমার হাত দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে ভীতকণ্ঠে বলেন, প্লিজ, আমাকে রেখে কোথাও যাবেন না। তাহলে আমি ভয়ে মরে যাব। আপনি আছেন বলে তেমন ভয় লাগছে না। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি।
তার অসহায়তা আমাকে দারুণভাবে আপ্লুত করে। বুঝতে পারলাম, আমার ওপর তার আস্থা রয়েছে। তাকে রেখে কোথাও যাওয়ার কথা বাদ দিলাম কিন্তু তার জন্য কিছু একটা করার ব্যাপারে উসখুস করতে থাকি। আমার প্যান্টের পকেটে থাকা রুমালটা তাকে মাথা-মুখ মুছতে দেই। তাতে কি আর কিছু হয়? আমার পরনে ফুল স্লিভ শার্ট। তার নিচে স্যান্ডো গেঞ্জি। কিছু না ভেবেই আমি ভিজে চুপসে যাওয়া শার্টটা খুলতে থাকলে সে অবাক হয়ে প্রশ্নমাখা চোখে আমাকে দেখতে থাকে।
শার্টটা চিপড়িয়ে চিপড়িয়ে তাকে পরতে দেই। একটা সিনেমায় এমনটা দেখেছিলাম। সেই মুহূর্তে তা মনে পড়ে যায়। সে কিছুতেই নেবে না। অনেক বোঝানোর পর শার্টটা নিয়ে ভিন্ন কৌশলে পরিধান করে। তাকে ফ্যাশন শোয়ে অংশ নেওয়া বিচিত্র ঢঙের মডেলের মতো লাগতে থাকে। শার্টটা নেওয়ার পর সিনথিয়ার চোখেমুখে ফুটে উঠে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা। তার জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি বলে আমিও স্বস্তি পাই। এরপর দুজনের মধ্যে বাতচিৎ হতে থাকে। একে অপরের সম্পর্কে জানাশোনা হয়। সিনথিয়াদের বাসা মিরপুরে। ইডেন গার্লস কলেজে অনার্স পড়ে। চার ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বাবা সরকারি চাকুরে। মা স্কুলের শিক্ষিকা। দুজনের মধ্যে আরও অনেকক্ষণ গুটুর- মুটুর চলে।
শার্ট সিনথিয়াকে দিয়ে বীরত্ব দেখালেও ভেতরে ভেতরে কাঁপন অনুভব করতে থাকি; কিন্তু তখন তো আর কিছু করার নেই। অদ্ভুত ব্যাপার, সেই সময় বৃষ্টির দিনে রিকশায় ব্যবহৃত হওয়া একটা পলিথিন কোথা থেকে যেন উড়ে এসে পড়ে অথবা আগেই পড়েছিল, খেয়াল করিনি। কার জিনিস সেটা আর বিচার-বিবেচনা করার অবকাশ ছিল না। টুটাফাটা হলেও সেটা যেন পরম কাঙ্ক্ষিত হয়ে আসে। বৃষ্টির ঢল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভালোই অবলম্বন হয়ে ওঠে।
তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বৃষ্টি থামার কোনো নিদর্শনই দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির সুরমাধুর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে সম্মিলিত ব্যাঙের ডাক। পরিবেশটা উপভোগ্য হলেও আমাদের মনোভাব তখন অনেকটা এমন, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। চারপাশে কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে। বন্ধুরা কে কোথায় জানতে পারছি না; কিন্তু মন বলছে, এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। কখন কোন অঘটন ঘটে যায়। চিন্তাটা সিনথিয়াকে নিয়েই বেশি। তার চোখমুখেও ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগের ছায়া।
বুঝতে পেরে তাকে বললাম, বলেন তো, কী করা যায়?
সিনথিয়া চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো সদুত্তর দিতে পারে না৷ যেন আমিই তার গার্জিয়ান। আমার উপরই সব কিছু নির্ভর করছে। আমি বললাম, যা থাকে কপালে চলেন হাঁটা দেই। নতুবা এর চেয়ে বড় বিপদ হতে পারে। আমার কথায় সম্মতি দেয় সিনথিয়া। পলিথিন মাথায় দিয়ে তুমুল বর্ষণের মধ্যে আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। পথেরও দিশা পাচ্ছিলাম না। কাছে-ধারে কোনো মানুষজনের অস্তিত্ব নেই। সবাই যেন হাওয়া হয়ে গেছে। সিনথিয়া হোঁচট খেয়ে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে রক্ষা করি।
উল্টাপাল্টা অনেকটা হাঁটার পর নির্মাণাধীন ছোট্ট একটা ভবনের দেখা পাই। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক বাদামওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়। সে সময় মানুষ না থাকাটা যেমন অস্বস্তির। আবার থাকাটাও স্বস্তিদায়ক নয়। কার মনে কী আছে, কে জানে? একান্ত নিরূপায় হয়ে বাদামওয়ালার কাছে যাই। তার কাছ থেকে পথের দিশা নিয়ে ছুটতে থাকি। বৃষ্টির ছোবল আর এবড়োখেবড়ো পথে হেঁটে যাওয়া কি যে কঠিন, সেটা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারছিলাম।
যাই হোক, ঠক্কর ঠক্কর খেতে খেতে বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বের হয়ে আসার পর চোখেমুখে আরও অন্ধকার দেখতে থাকি। জন্ডিস রোগের মতো এদিক-সেদিক টুকটাক আলো জ্বলছে; কিন্তু কোনো যানবাহন নেই। তবে চিড়িয়াখানার সামনে দুজন রিকশাচালক পলিথিন মুড়ে সিটে আরাম করে বসে আছে। তারা কোথাও যাবে না। অনেক অনুনয়-বিনয় করে একজনকে বললাম, আপনি যা চাইবেন, সেই ভাড়া দেবো। এরপরও অনেক গড়িমসি করে রাজি হয়। সেদিন সিনথিয়াকে বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পেরে স্বস্তির নি:শ্বাস ছেড়েছি।
এরপর সিনথিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠে তাদের বাসার টিঅ্যান্ডটি ফোন। ইডেন কলেজের কাছে তার অপেক্ষায় কত দিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করেছি। সিনেমা দেখেছি। হাবিজাবি খেয়েছি। সঙ্গে ছিল আদর-সোহাগও। সে ছিল বড় সুখের সময়; কিন্তু সব দিন তো একরকম যায় না। একদিন আমার সঙ্গে রিকশায় সিনথিয়াকে দেখে ফেলেন তার বড় ভাই। তার খেসারত দিতে হয়। সুখের দিনগুলো কমে আসে। তারপরও লুকিয়ে-চুরিয়ে মাঝে-মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। সুযোগ পেলে ফোনে কথা হয়। তখন তো আমরা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছি।
এমন অবস্থায় দুঃসংবাদের মতো করে সিনথিয়া জানান, বিদেশে কর্মরত একজনের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কান্নাভেজা কণ্ঠে আমাকে বলে, তুমি কিছু একটা করো। আমি তখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। যদিও সংসার চালানোর মতো খুব একটা সামর্থ্য নেই। পরিবারের সঙ্গে থাকি। তারপরও আমরা নিজেরাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। একটা ডেট ঠিক করে তাকে নির্ধারিত সময়ে মিরপুর পূরবী সিনেমা হলের কাছে থাকতে বলি।
আমি বাসা থেকে সময়মতো রওনা দেই। সেদিনও ধুম বৃষ্টি নামে। রিকশা পেতেও দেরি হয়ে যায়। রিকশায় আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত গিয়ে বাসে ওঠি। বাস চলতে থাকে মন্থর গতিতে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। মারাত্মক যানজট লেগে যায়। বুকের মধ্যে তীব্র অস্থিরতা। আমি যখন পূরবী হলের কাছে পৌঁছাই, ততক্ষণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সিনথিয়ার দেখা পেলাম না। না পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একটা মেয়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে একা একা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারে? নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আমি কখন আসব, সে বুঝবে কিভাবে? সেই অবস্থায় মাথার মধ্যে অনেক দুর্ভাবনাই আসতে পারে। পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে মনের মধ্যে অনেক রকম দোলাচল চলতেই পারে। তার সঙ্গে ডেটিং করার সময় বরাবরই আমি নির্ধারিত সময়ের আগেই হাজির হয়েছি। অথচ আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে আমি এতটা দেরি করলাম!
এরপর আর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। যোগাযোগের সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তবে শুনেছি, নির্ধারিত পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে বিদেশে চলে যায়। যদিও আমি অনেকগুলো বছর তার প্রতীক্ষায় থেকেছি।
তখন যদি মেট্রোরেল থাকত, তাহলে সিনথিয়া আমার জীবন থেকে দূরে সরে যেতে পারত না। এখন চাইলেও মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত যে কোনো দূরত্বে চোখের পলকেই যাওয়া-আসা করা যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই মেট্রোরেলের মেয়েটি রেকর্ডকৃত গলায় মধুর কণ্ঠে জানিয়ে দেয়- গন্তব্যে এসে পড়েছি। নামার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেই ভদ্র মহিলা আর মেয়ে দুজন নেই। বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে ওঠে। শূন্যতার অনুভূতি নিয়ে মেট্রোরেল থেকে নেমে বাইরে এসে দেখি- ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। রিকশা নেব নাকি বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যাব, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।