গল্প
ময়ূরকণ্ঠী বিকেল
সৈয়দা সালমা খায়ের
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এষা আর ইমা ওদের ছাদে হাত ধরে হাঁটছিল। এষার আজ জন্মদিন। তাই ওর মনটাও কেমন যেন অন্য রকম ভালোলাগায় ভরে আছে। প্রতিবারের মতো এবারও ও ওর মায়ের দেওয়া শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরতে ওর খুব ভালো লাগে। ময়ূরকণ্ঠী রঙে ওকে লাগছেও দারুণ।
-এষাপু ওই গানটা একটু গাওনা...
-কোনটা?
-ওইযে...ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে...
-তাইলে তুইও আমার সাথে গাইবি।
-আপু এই কথা প্লিজ বলো না, মায়ের এই প্রিয় ছাদ পচা ডিম দিয়ে ভরে যাবে যে...
-তুই না, যা একেকটা কথা বলিস!
-প্লিজ শুরু কর এষাপু...শুরু করোনা...
এষাও গলা ছেড়ে গান গাইছিল একের পর এক, কেউ গান গাইতে বললে ওর আর না নেই। ও খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়।
ইমা দেখল, পাশের বাসার ছাদ থেকে একজন অতিমাত্রার সুদর্শন লোক মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর আপুর গান শুনছে আর অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। লোকটিকে মনে মনে ওর আপুর জন্য পছন্দও হয়ে গেল। ও চালাকি করে আপুকে দিয়ে একের পর এক গান গাওয়াচ্ছিল, একটুও থামতে দেয়নি। এষাও মন-প্রাণ দিয়ে গাইছিল, আর তাই কোনো দিকেই ও খেয়াল করেনি।
-আপু, চলো, বাসায় চলো। দেরি হলে আবার মা বকাঝকা করবে আমাকে। তোমাকে তো আর বকবে না।
ইমা চিন্তা করছিল, এই সুদর্শন লোকটিকে তো ও কখনো দেখেনি পলাদের বাসায়, এ তাহলে কে? জানতে হবে ওর।
এষা ও ইমা দুই বোন। ওদের বাবা শাহেদ চৌধুরী ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজির অধ্যাপক আর মা গৃহিণী। যদিও তিনি বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। মেয়েদের জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। বেশ সুখের সংসারই বলা যায়। এষা মাস্টার্স করে ফেলেছে এ বছর। একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াচ্ছে কিছুদিন হলো। বাবা-মার ইচ্ছা, ভালো ছেলে পেয়ে গেলে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। কারণ এলাকার কিছু বাজে ছেলে খুব ঝামেলা করছে, বেশ কিছুদিন হলো। সবাইকে তাই বলেও রেখেছেন ভালো ছেলে দেখার জন্য।
ওদের চারজনকে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। খুব সুন্দর সম্পর্ক বাবা-মা আর মেয়েদের মধ্যে।
-এষার মা...এষার জন্য তো ভালো একটা প্রস্তাব এসেছে, ছেলে ডাক্তার। দেখতেও মোটামুটি ভালো।
ইমা কথার মাঝে কথা বলে ফেলল,
-বাবা, মোটামুটি দেখতে কারও সাথে তো আমি আপুর বিয়ে দিতে পারি না, বাবা। আপুকে বিয়ে দেব সুদর্শন কোনো যুবকের সঙ্গে। তাছাড়া এষাপু তো ডাক্তার পছন্দ করে না।
-মারে, সবদিক মিলিয়ে তো পাওয়া যাবে না। আর তুই ওর বিয়ে দেওয়ার কেরে?
-আমার ওপর একটু ভরসা রাখ তোমরা...দেখ, আমিই এষাপুর বিয়ে দেব।
এষা আর এষার মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এষা তো কিছুই জানে না।
এষার মা বললেন,
-ইমা তুই বেশি পেকে গেছিসরে, বেশি কথা বললে তোকেই বিয়ে দিয়ে দেব, তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে পড়তে যা। বানর একটা। সামনে এইসএসসি পরীক্ষা, কোনোই চিন্তা নেই।
এষা বলল,
-একদম ঠিক বলেছ, মা ওকেই বিয়ে দিয়ে দাও।
-তা তো বলবাই এখন, যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর। যাচ্ছি, যাচ্ছি। পড়তে যাচ্ছি।
ইমা পরের দিন কলেজে গিয়েই সব বের করে ফেলল, ওর বন্ধু পলার কাছ থেকে। পলাই বলল যে, ওর এক কাজিন এসেছে গতকাল জাপান থেকে, সঙ্গে ওর বাবা-মা। ওর খালামণির একটাই ছেলে। উদ্দেশ্য ছেলের একটা ভালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া, যেন ভাইয়া কোনো জাপানিজ না বিয়ে করে ফেলে। নাক বোঁচা মেয়ে ওর খালার খুবই অপছন্দ। তো তার ছেলে যে একদিনেই মেয়ে পছন্দ করে ফেলবে, তা কে জানত? কলেজ ছুটির পর ওরা যখন হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিল তখনই এসব বলছিল ইমাকে।
পলা বলল,
-জানিস ইমা, ভাইয়ার নাকি মেয়ে পছন্দও হয়ে গেছে, মেয়ে নাকি খুবই মিষ্টি দেখতে, আবার গানও জানে।
-তাই নাকি? (যেন ইমা কিছুই বুঝতে পারেনি) তোর ভাইয়া বুঝি গানও শুনে ফেলেছে? পরি-টরি দেখেনি তো আবার?
-আরে না, রাত হয়ে গিয়েছিল তো, তাই আর বাসাটা দেখাতে পারেনি। আজ দেখাবে। তারপর মা আর খালা মিলে ওই বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবে। ভাইয়ার যে যোগ্যতা, যে কোনো বাবা-মা লুফে নেবে।
-তাই বুঝি? ছাদে গিয়ে তোর ভাই বুঝি পরির প্রেমে পড়েছে? তাইলে আজ বিকালে তোরা ছাদে আসবি?
-হ্যাঁ, দেখি কোন সে পরি? আমার অবশ্য একজনকে সন্দেহ হচ্ছে।
-কেরে?
-না থাক, পরে বলব। দেখি আগে আমার অনুমান মেলে কিনা?
-আচ্ছা, পরেই বলিস।
-ছাদে উঠিস, দেখা হবে।
-ওকে, ডিয়ার।
যে যার বাসায় চলে গেল।
-এ কি আপুনি তুমি আবার ওই শাড়িটাই পরলে?
-খুব সুন্দর শাড়িটা। মনে হলো, আর একবার পরি।
-তাহলে তো ভালোই হলো, চিনতে সুবিধা হবে।
-তুই কী বললি? না তুই কী বললি, বল?
-আমি কিছুই বলিনি।
-এষাপু, আজও কিন্তু ছাদে যাব।
-ঠিক আছে।
পলা ওর খালামণি আর মাকে নিয়ে ছাদে উঠল। আর এইদিকে ইমাও বুদ্ধি করে ওর মাকেও ছাদে নিয়ে এসেছিল। কারণ ও তো পুরোপুরিই বুঝে গিয়েছিল।
পলা ইমাকে ডাকল। ওদের সবার সঙ্গেই কথা হলো। শুধু এষা কোনো কথা বলেনি। ওর কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছিল। লোকটা কেমন করে বারবার শুধু ওকেই দেখছিল। যদিও লোকটা খুবই সুদর্শন দেখতে।
পরের দিনই পলা ওর মা আর খালাকে নিয়ে হাজির। ইমা যদিও ওর মা-বাবাকে কিছুটা আভাস দিয়ে রেখেছিল।
সত্যিই ওরা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। পলার কাজিন জাপানেরই একটি ব্যাংকে আছে। বেশ ভালোই অবস্থা। ছেলের বাবাও ওখানে ব্যবসা করে।
বিয়ের আলোচনা শেষ হলো, বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। সময় খুব বাকি নেই। আগামী মাসেই বিয়ে। বিয়ের পর যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ওরা এষাকে নিয়ে যাবে। মেয়ে ওদের খুবই পছন্দ হয়েছে।
পলা, ইমা, এষা আর আকাশ মিলেই বিয়ের অধিকাংশ শপিং করে ফেলল।
নির্দিষ্ট দিন সানাই বেজে উঠল। আকাশ আর এষার বিয়ে হয়ে গেল।