
প্রিন্ট: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১৭ পিএম
নিরুদ্দেশ মহসিনকে খুঁজে পেতে স্বজনদের আকুতি

মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৭ এএম
-6744009a57dae-67fca3b6b205c.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
‘ভাইয়ের ছবি নিয়ে নানা জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছি। হাসপাতাল, থানা, রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্টেশন—কোনো জায়গায়ই বাদ রাখিনি। কিন্তু ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না,’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন রুমা ফেরদৌসী। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলকিপার মো. মহসিনের বোন রুমা।
মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক তারকা গোলকিপার মো. মহসিন আট মাস ধরে নিখোঁজ। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। গত বছরের ২৬ আগস্ট মালিবাগের বাসা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন মহসিন। এর আগে গত বছর মার্চেও একবার হারিয়ে গিয়েছিলেন। সেবার তিনদিন পর তাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এবার আর পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলকিপার মহসিনের বোন রুমা ফেরদৌসী কাল দৈনিক যুগান্তরের অফিসে এসেছিলেন। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘আট মাস ধরে ভাইয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় হারিয়ে গেলেন? আর কোথায় খুঁজব তাকে?’
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের একটি ফ্ল্যাটে ছিলেন অসুস্থ মহসিন। তার নিউরো চিকিৎসা চলছিল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। কিছু মনে করতে পারতেন না। গত ২৬ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা গোলকিপারদের আলোচনায় সান্টু-মহসিন-আমিনুলের নাম প্রায় সমানভাবে উচ্চারিত হয়। গোলের খেলা ফুটবলে গোলকিপার হয়েও আশি-নব্বইয়ের দশকে অনেক বড় তারকা ছিলেন মহসিন। জাতীয় দলের পাশাপাশি দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী এবং মোহামেডানে খেলেছেন দীর্ঘদিন। দুই বড় ক্লাবের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রেরও অধিনায়ক ছিলেন।
বছরতিনেক আগে হঠাৎ নিউরোর সমস্যা দেখা দেয় মহসিনের। তখন যুগান্তরের প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘আমি সুস্থ হতে চাই। আমি বাঁচতে চাই। দয়া করে আমাকে বাঁচার সুযোগ করে দিন।’
গোলপোস্টের নিচে অতন্দ্রপ্রহরী ছিলেন। বাঘা বাঘা ফরোয়ার্ডদের আক্রমণ রুখেছেন দৃঢ়হস্তে। সেই হাতই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। নিজ হাতে খেতে পারতেন না ঢাকার মাঠের একসময়কার এই দাপুটে গোলকিপার। বিছানায় শুয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন।
কথা বলার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার দেহের দিকে তাকালে যে কারও চোখে জল আসতে বাধ্য। এই প্রতিবেদকেরও চোখ ভিজে গিয়েছিল। মহসিন যেন জীবনের শেষ লগ্নে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এই সাবেক গোলকিপার তখন দাঁড়িয়েছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট ঢাকার মানিকগঞ্জে জন্ম তার। ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেন রেলওয়ে ব্লুজের হয়ে। একই বছর রেলওয়ে দলের হয়ে শেরেবাংলা কাপে অংশ নেন। ওই বছর আবাহনীর আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুও জাতীয় ফুটবলে রেলওয়ের হয়ে খেলেন।
মহসিনের খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আবাহনীতে নিয়ে আসেন চুন্নু। ১৯৮২ সালে যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। টানা পাঁচ বছর মোহামেডানের গোলপোস্ট আগলিয়েছেন পরম মমতায়। ১৯৮৫ সালে তিনি মোহামেডানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৭ সাল থেকে আবারও তার ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়া চক্র। টানা সাত বছর খেলেন আবাহনীতে। ১৯৯১ সালে তার নেতৃত্বে আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনিই একমাত্র ফুটবলার, যিনি একই সঙ্গে দেশের দুই ঐতিহ্যবাহী দলেরই অধিনায়ক ছিলেন। আবাহনীর হয়ে তিনবার এবং মোহামেডানের হয়ে দুবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দলে খেলেছেন।
এছাড়া ১৯৮২ সালে ভারতের কলকাতায় আশীষ জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল চ্যাম্পিয়ন, ভারতের নাগজি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯৪ সালে কলকাতার চার্মস কাপে চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে তিনি দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন।
মহসিন ঘরোয়া ফুটবলের মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচেও সুনামের সঙ্গে খেলেছেন। ১৯৮২ সাল থেকেই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত খেলেন। খেলা শেষ করে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নিজের স্কিল, আই সাইট, পজিশন জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা দিয়ে বারবার প্রমাণ করেছেন তিনিই দেশসেরা গোলকিপার। আর তাই বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাসে দুই প্রতিপক্ষ মোহামেডান ও আবাহনীর লাখ লাখ সমর্থকের হৃদয়ে আজও দীপ্যমান গোলকিপার মহসিন।
তিনি ঢাকা ফুটবলের তিন প্রধান মোহামেডান, আবাহনী এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৯৫ সালে অবসান ঘটে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। পরে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারও পেয়েছেন এই মহসিন। অসীম দক্ষতায় গোলবার আগলে রাখা সেই মানুষটিই বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন।
২০১৪ সালে অসুস্থ মাকে সেবা করার জন্য কানাডা থেকে চলে আসেন এই ফুটবলার। স্ত্রী সঙ্গে আসেননি। পরে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। মাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যেতেন না মহসিন। ৯০ বছর বয়সি মায়ের সেবা করাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। সেই ছেলেকে খুঁজে না পাওয়ায় মা এখন শয্যাশায়ী। দিনরাত মহসিনের জন্য কাঁদেন।
অন্য ছেলেমেয়েদের কোনো সান্ত্বনাই মায়ের মন ভুলাতে পারছে না। বোন রুমা ফেরদৌসীর কথা, ‘মহসিন দাদা এই দেশের জন্য নিজের সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেই ভাইকে খুঁজে মায়ের কোলে ফেরত দেওয়ার কোনো সহযোগিতা কি আমরা রাষ্ট্রের কাছে পাব না? সরকারের কাছে আমার আবেদন, মহসিন শুধু আমার ভাই নন, দেশেরও সম্পদ। সেই ভাইকে খুঁজে বের করা সরকারের কাছে বড় কোনো বিষয় নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কত অসাধ্য সাধন করে। সেখানে একজন কিংবদন্তিকে খুঁজে বের করতে পারবে না এটা আমি বিশ্বাস করি না। তারা একটু সদয় হলেই আমার ভাইকে আমরা ফিরে পেতে পারি।’